মধুভাতের স্বাদ মিষ্টি হলেও, এটি তৈরি করতে এক চিমটিও চিনি কিংবা এক ফোঁটাও মধু ব্যবহার করা হয় না। তাহলে এত মিষ্টি আসে কোথা থেকে?
কোনো এক বৃষ্টিভেজা সকালে মায়ের হাতে রান্না করা গরম খিচুড়ির গন্ধ, কিংবা শীতের বিকেলে দাদির বানানো পিঠার স্বাদ—এসব খাওয়ার মুহূর্ত আমাদের স্মৃতির পাতায় অমলিন থেকে যায়। খাবারের সঙ্গে স্মৃতির এক অদ্ভুত সম্পর্ক! এই তো, ঈদের সেমাই, কোরবানির মাংস কিংবা পূজোর খিচুড়ি-নাড়ু—এসব মানুষের কাছে শুধু খাবার নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কত শত ‘নস্টালজিয়া’।
এসব অনুভব থেকেই হয়তো বলা হয়, খাবার নাকি শুধু পেট নয়, মনও ভরায়। কথাটির সত্যতা বাস্তব জীবনেও মেলে। বিদেশের মাটিতে বসে যদি কখনো দেশি কোনো খাবারের গন্ধ পান, তবে তা যে কতটা আবেগ ছুঁয়ে যায়—তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন! নিজের ঘরের, এলাকার কিংবা দেশের খাবারের প্রতি মানুষের টান সত্যিই আজীবনের।
এই যেমন, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকার মানুষের কথা ধরা যাক। তাদের কাছে নিজস্ব খাবারের ঐতিহ্য বহন করে এক অনন্য আবেগ। প্রতিটি মানুষের জেলা বা দেশভিত্তিক নিজস্ব একটি খাদ্যসংস্কৃতি থাকে, যা সেখানকার মানুষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে যেমন ভাত, মাছ, ভর্তা সাধারণ একটি খাবার, তেমনি ইতালিয়ানদের জন্য পাস্তা বা জাপানিদের জন্য সুসি—এগুলো সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। অর্থাৎ, খাবার শুধু স্বাদের বিষয় নয়, বরং শেকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার অন্যতম মাধ্যমও।
মধু ছাড়াই ভাত
তেমনি চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো ‘মধুভাত’। অঞ্চলটির প্রায় সবার কাছেই এটি বেশ প্রিয়। চট্টগ্রামের ছেলে-বুড়ো—যেকোনো একজনকে জিজ্ঞেস করলেই মিলবে মধুভাতের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসার গল্প।
নামের আগে ‘মধু’ থাকলেও, এই ভাতে মধুর বিন্দুমাত্র ব্যবহার নেই। তবু স্বাদে যেন সত্যিই খাঁটি মধুর মতোই মিষ্টি। চাটগাঁইয়া খাদ্যসংস্কৃতির এটি এক অনন্য উপাদান, যা একসময় শহর থেকে গ্রাম—সর্বত্রই ছিল দারুণ জনপ্রিয়।
মধুভাতের স্বাদ মিষ্টি হলেও, এটি তৈরি করতে এক চিমটিও চিনি কিংবা এক ফোঁটাও মধু ব্যবহার করা হয় না। তাহলে এত মিষ্টি আসে কোথা থেকে?
এই রহস্যের উত্তর লুকিয়ে আছে এর মূল উপাদান—জালা চালে। ধান চারা তৈরির জন্য যে ধান ভিজিয়ে রাখা হয়, সেখান থেকেই তৈরি হয় জালা চাল। এই ধান ভিজিয়ে রেখে অঙ্কুরিত করা হয়, তারপর স্তূপ করে রেখে দেওয়া হয় ১০ থেকে ১৫ দিন। এরপর তা শুকিয়ে ঢেঁকিতে বা মেশিনে কুড়িয়ে তৈরি হয় চালের গুঁড়া। এই গুঁড়ো চাল দিয়েই তৈরি হয় মধুভাত, যা প্রাকৃতিকভাবেই হয় মিষ্টি ও সুগন্ধী। তবে যারা অতিরিক্ত মিষ্টি পছন্দ করেন, তারা খাওয়ার সময় সামান্য চিনি মিশিয়ে নেন।
আমার এক বন্ধুর কথাই বলা যাক। তার গ্রামের বাড়ি যশোরের চৌগাছায়। একবার আলাপের সময় সে জানালো, যশোরে নির্দিষ্ট এক ঋতুতে বাড়ি বাড়ি কুমড়োর বড়ি বানানোর আয়োজন হয়। সে সময় চারদিকে রীতিমতো উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিবছরই এমন আয়োজন চলে। যদি কোনো বাড়িতে কোনো কারণে বড়ি বানানো না হয়, তাদের কাছে যেন উৎসবই ফিকে হয়ে যায়। তবে আশপাশের মানুষজন বড়ি পাঠিয়ে সেই আনন্দ ভাগ করে নেন।
চালকুমড়া আর মাসকলাইয়ের ডালে তৈরি এই খাবারটি স্বাদে খুব আহামরি কিছু না হলেও, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আবেগ একে করে তোলে ‘বিশেষ’।
তৈরির পদ্ধতি
মধুভাত তৈরির প্রক্রিয়া কঠিন নয়, তবে কিছুটা সময়সাপেক্ষ।
প্রথমে বিন্নি চাল কিংবা সুগন্ধি নতুন আতপ চাল রান্না করে নিতে হয়। এরপর একটি বড় ডেকচিতে সেই রান্না করা ভাতের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় জালা চালের গুঁড়া। তারপর ডাল ঘুটনি দিয়ে ভালোভাবে মেশানো হয় চালের গুঁড়ার সঙ্গে গরম ভাত।
এরপর একটি বড়, পরিষ্কার পলিথিন বা কাপড় দিয়ে পাতিলের মুখ শক্ত করে বেঁধে রাখা হয় সারারাত। পরদিন সকালে বা দুপুরে পলিথিন বা কাপড় সরিয়ে দেখা যায়, ভাতটি যেন পায়েস বা ফিরনির মতো রূপ নিয়েছে—ঠিক তখনই মধুভাত খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
পরিবেশনের সময় উপরে কোড়ানো নারকেল ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কেউ কেউ আবার কিসমিস বা বাদামও যোগ করেন বাড়তি স্বাদের জন্য।
আগে এই ভাত এমনভাবেই খাওয়া হতো। এখন অনেকেই ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে খেতে পছন্দ করেন। স্বাদে এটি অনেকটা ফিরনির মতো হলেও ফিরনিতে যেমন চিনি বা গুড় থাকে, মধুভাতে সেসব ব্যবহার করা হয় না। আবার ফিরনিতে যে ঘ্রাণ পাওয়া যায়, তা মধুভাতে নেই। বরং রয়েছে এর নিজস্ব এক প্রাকৃতিক মৌ মৌ গন্ধ। স্বাদেও থাকে এক ধরণের টক-মিষ্টির ছোঁয়া।
তবে যারা মধুভাত কখনও খননি, তাদের কেউ কেউ ধারণা করেন—রাতভর পলিথিনে মুখ বন্ধ করে রাখার ফলে এতে দুর্গন্ধ হতে পারে। অথচ বাস্তবে বিষয়টি একেবারেই উল্টো। বরং মধুভাতে থাকে একধরনের মিষ্টি, স্বাভাবিক সুগন্ধ যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয়। এমনও অনেকে আছেন, যারা শুধুমাত্র এই ঘ্রাণের কারণেই মধুভাতের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট।
লোকজ ঐতিহ্য
মজার বিষয় হলো—একসময় মধুভাত রান্না হতো রাতে, চুপিসারে। কেন? যেন বেশি মানুষ দেখে না ফেলে! শোনা যায়, চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে এক বিশ্বাস প্রচলিত ছিল—মধুভাত রান্নার সময় যদি অনেক লোক জানে, তবে সেটি ‘উঠে না’। অর্থাৎ, ঠিকঠাকভাবে তৈরি হয় না।
তাই রাতে নিঃশব্দে চলত নারকেল কাটা ও চাল ঘুঁটার কাজ। আর সকালে খাবারের টেবিলে হাজির হতো মধুভাত। পরিবারের সবাই মিলে আয়েশ করে খেতেন। এমনকি মধুভাতের এই আয়োজন উপলক্ষে আপনজনদের দাওয়াতও দেওয়া হতো। আবার বাটি ভরে প্রতিবেশীদের বাড়িতেও পাঠানো হতো।
চট্টগ্রামের নিজস্ব লোকজ ঐতিহ্য অনুযায়ী, মধুভাত তৈরির উপযুক্ত সময় গ্রীষ্মকাল ও ভাদ্র মাস। কারণ এই সময়ের গরমে ভাতটি সহজে রূপ নেয় মধুভাতে। অনেকে বলেন, ভাদ্র মাসের মধুভাত সবচেয়ে বেশি মিষ্টি হয়। এটি শুধু চট্টগ্রামের খাদ্যসংস্কৃতির নয়, সামাজিক সংস্কৃতিরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আগে যার ঘরে মধুভাত রান্না হতো, তিনি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠাতেন তা বাটি ভরে। এমনকি নববিবাহিত মেয়ের বিয়ের প্রথম বছরে শ্বশুরবাড়িতে কলসভর্তি মধুভাত পাঠানো ছিল বাধ্যতামূলক রীতি।
যেমনভাবে ফলের দিনে ফল, কোরবানির ঈদে মাংস কিংবা বিয়ের তিন দিন পর দুধ-কলার মতোই নিয়ম করে মধুভাত পাঠানোর চলও ছিল। এই প্রথায় দুই পরিবারের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতো বলে বিশ্বাস করা হতো।
চট্টগ্রাম গবেষক আবদুল হক চৌধুরী তার বই ‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা’-তেও এ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “চট্টগ্রামে নববিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম বছর মধুভাত পাঠানো বাধ্যতামূলক।”
একসময় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে মধুভাত পাঠানো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, এটি না পাঠালে বিষয়টিকে শোভনীয় মনে করা হতো না। যার ঘরে মধুভাত রান্না হতো, তিনি তা প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।
এ নিয়ে কথা হলো রোকসানা আরার সঙ্গে—জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে, বয়স ৬৮ পেরিয়েছে। পেশায় গৃহিণী। তিনি বলেন, “এসব খাবার পাঠানোর রীতি মানার মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়—আম্মারা তাই বলতেন। আম্মার কাছ থেকেই আমরা শিখেছি। আমরা বিশ্বাস করি, এভাবে একসাথে কিছু খেলে ভালোবাসা বাড়ে।”
শুধু তিনিই নন, অনেকের মতে—চাটগাঁইয়া সমাজে মধুভাত দেওয়া-নেওয়া ছিল পারস্পরিক সৌহার্দ্যের প্রতীক।
মধুভাতের ইতিহাস
চট্টগ্রামে এই ভাতের প্রচলন ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা নিয়ে কারো কাছে নির্ভরযোগ্য কোনো ধারণা নেই। কীভাবে এটি এখানকার সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়াল, সে বিষয়েও জানা যায় না তেমন কিছু। সবার মুখে মুখে শোনা যায় একটাই কথা—”অনেক আগের থেকেই খাওয়ার চল আছে।”
এই যেমন রিয়াজ উদ্দিনের কথা ধরা যাক। বয়স ৭৮ পেরিয়েছে, থাকেন চট্টগ্রামের কাপাসগোলা এলাকায়। তার ভাষ্যে, মধুভাতের প্রচলন কবে থেকে তা জানা বেশ কঠিন। তিনি তার মাকে, চাচিকে, দাদিকে এটি রান্না করতে দেখেছেন।
তিনি বললেন, “আমার বড় বোনের বয়স হয়েছিল ১১০ বছর। তাকেও যেমন করতে দেখেছি, তেমনি মা আর দাদিকেও। এখন আমার স্ত্রীও মধুভাত রান্না করে। তাকেও যদি জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে শিখেছেন, হয়তো একই উত্তর দেবে।”
মধুভাতের উৎপত্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই, তবে অনেক গবেষকের মতে, এর ঐতিহ্য প্রায় ১,৪০০ বছর পুরনো। ধারণা করা হয়, সুফি সাধক বার আউলিয়ার আগমনের সময় তারা চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি নিজেদের কিছু খাদ্যাভ্যাস স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। মধুভাতও হয়তো তার একটি নিদর্শন। সময়ের সঙ্গে তা এখানকার লোকজ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে—ঠিক যেমনটি মেজবান রেওয়াজ।
আবার কেউ কেউ ধারণা করেন, আরাকান আমলে মানুষ মধু মিশিয়ে ভাত খেত। হয়তো সেখান থেকেই এসেছে ‘মধুভাত’ নামটি। তবে রন্ধনপ্রণালি সময়ের সঙ্গে বদলেছে বলে ধারণা অনেকের। হয়তো নাম থেকে গেছে, কিন্তু প্রক্রিয়ায় এসেছে ভিন্নতা।
চট্টগ্রাম গবেষক হারুন রশীদ বলেন, “আমার কেন যেন মনে হয়, এটা দক্ষিণ দিক থেকে আসা সংস্কৃতি। ভাত তো দক্ষিণ দিক থেকেই এসেছে। সুফিদের উৎস এলাকা থেকে ভাতের প্রচলন বেশি ছিল না। তাই আমার কাছে আরাকানি ব্যাখ্যাটাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়।”
তিনি জানান, তার পরিবারেও তিন পুরুষ ধরে এই ঐতিহ্য অনুসরণ হয়ে আসছে। এটি চাটগাঁইয়া অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম উপাদান বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য
একসময় চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে মধুভাত রান্না হতো, উৎসব করে। এখন আর আগের মতো সেই আয়োজন দেখা যায় না। সময়ের অভাব, দীর্ঘ প্রস্তুতির ঝক্কি এবং দ্রুত জীবনের চাপে অনেকেই আর আগ্রহ পান না। এখন কেবল গ্রামের কিছু পরিবার এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শহরাঞ্চলে বলতে গেলে এটি প্রায় বিলুপ্ত। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই মধুভাত অপরিচিত।
অথচ মধুভাত শুধু একটি খাবার নয়—এটি চট্টগ্রামের সমাজ-সংস্কৃতির, স্মৃতি আর সৌহার্দ্যের প্রতীক।