Friday, June 6, 2025
More
    Homeমতামতমার্কিন-ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ঐক্য

    মার্কিন-ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ঐক্য

    ইসরায়েলের একার নয়, গাজায় গণহত্যার দায় যুক্তরাষ্ট্রেরও। ইসরায়েলি দখলদারি মতাদর্শ জায়নবাদও একা ইসরায়েলের নয়, এটি একটি ইউরোপিয়ান প্রোডাক্ট। ফিলিস্তিন তাই কেবল মধ্যপ্রাচ্যের একটি অধিকৃত, লুণ্ঠিত ও রক্তাক্ত ভূখণ্ড মাত্র নয়— ফিলিস্তিন বৈশ্বিক মানবতা ও ঐক্যের আরেক নাম।

    গালভরা হাসি নিয়ে ফিলিস্তিন নিয়ে একটি নারকীয় ফন্দি আঁটতে দেখা গেল দুজনকে। গত ৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি। দু-জনের একজন আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণিত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, অন্যজন বহু যুদ্ধের পেছনের কলকাঠি নাড়া দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শান্তিবাদী মুখোশপরা ডনাল্ড ট্রাম্প। গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি চুক্তির রহস্যটা এবার বোঝা গেল। নেতানিয়াহুকে ট্রাম্পের গোপন বার্তা ছিল, পনের মাসে সে যা করেছে তা অসাধারণ, এবার পথ ছেড়ে ট্রাম্পকে বাকি কাজটা শেষ করতে দেওয়া হোক! তাদের এই ক্রুর হাসির সঙ্গে প্রকাশ হলো সেই নতুন ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা— ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র দখল করবে গাজা। মিসর ও জর্ডানকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন ফিলিস্তিনিদেরকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। ট্রাম্পের কোম্পানি ও তার জামাই মিলে সেখানে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা জমাবে। তারা সুরম্য সব অট্টালিকা বানিয়ে বিক্রি করবে ইসরায়েলি দখলদারদের কাছে! গাজা ও পশ্চিম তীরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার এমন পরিকল্পনাই প্রকাশ করেছে এই ফ্যাসিস্ট যুগল।

    মনে রাখা প্রয়োজন, ইসরায়েলের একার নয়, গাজায় গণহত্যার দায় যুক্তরাষ্ট্রেরও। ইসরায়েলি দখলদারি মতাদর্শ জায়নবাদও একা ইসরায়েলের নয়, এটি একটি ইউরোপিয়ান প্রোডাক্ট। ফিলিস্তিন তাই কেবল মধ্যপ্রাচ্যের একটি অধিকৃত, লুণ্ঠিত ও রক্তাক্ত ভূখণ্ড মাত্র নয়— ফিলিস্তিন বৈশ্বিক মানবতা ও ঐক্যের আরেক নাম।

    জায়নবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। যে কোনো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আজকের দুনিয়ার এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক-আদর্শিক দৈত্য। ভারতে বিজেপি-চর্চিত হিন্দুত্ববাদও ইসরায়েলি জায়নবাদের মতো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। এ দুটি রাজনৈতিক আদর্শই দুটি ধর্মের মধ্যকার মানবতাবাদী, কল্যাণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দিকগুলো ছুঁড়ে ফেলে ধর্ম দুটিকে ছিনতাই করেছে সন্ত্রাসবাদী ও সম্প্রসারণবাদী পুঁজির সেবায় ও স্বার্থে। ইসরায়েলি জায়নবাদ আরও ভয়ানক— হিটলারের হাতে হলোকাস্টের শিকার একটি জনগোষ্ঠী নিজেরাই এক হত্যাযজ্ঞ শুরু করল। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এটাই তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও জন্মগত সত্য।

    ১৯৪৭ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সৃষ্টি এক রকম পশ্চিমা অপরাধবোধ থেকে— পশ্চিমাদের উপহার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের নাৎসি ও ফ্যাসিবাদীদের হাতে হলোকাস্টের শিকার না হলে ফিলিস্তিন টুকরো করে ইসরায়েল সৃষ্টি করা সম্ভব হতো না। ইসরায়েলের জন্ম একটি ইউরোপিয়ান দখলদারি ঔপনিবেশিক প্রকল্প হিসেবে। ইহুদি বংশোদ্ভূত খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ইলান পাপের কথায়, “বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বেশিরভাগ জায়নবাদী নেতা জাতিগত পুনরুজ্জীবনকে যুক্ত করেছে ফিলিস্তিনের উপনিবেশিকরণের সঙ্গে।”

    নূর মাসালহা ফিলিস্তিনি ইতিহাসের চার হাজার বছর নিয়ে লেখা বইতে লিখেছেন, “জায়নবাদী দখলদারি ঔপনিবেশিকতার শিকড় ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদের গভীরে নিহিত। … উনবিংশ শতকের শেষ দিকে যখন সব ইহুদিদের জড়ো করে ফিলিস্তিনে দখলদার-উপনিবেশ স্থাপনের লক্ষ্য ঠিক হলো, ফিলিস্তিনে যে মানুষ বাস করে তা বেমালুম ভুলে গেল তারা। ১৮৯৭ সালে রাজনৈতিক জায়নবাদের যাত্রা শুরুর সময় প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসে গৃহীত বাসেল কর্মসূচিতে ফিলিস্তিনের মাটিতে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের কোনো উল্লেখই করা হয় না।” যে দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাসিবাদের ও দক্ষিণ আফ্রিকায় সংঘটিত বর্ণবাদের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ইউরোপ হারাতে থাকে তার উপনিবেশগুলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক, সামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের মাধ্যমে তার দখলদারি প্রকল্পটি কেবল বজায় থাকে না, শক্তিতে তা বাড়তেই থাকে। যা সম্ভব করেছে পৃথিবীতে একমাত্র সরাসরি সম্প্রচারিত বর্তমানের এই গণহত্যাযজ্ঞ। গাজায় আপাতত যুদ্ধবিরতি চললেও সেখানে শান্তি অনিশ্চিত। কারণ এতে যত না ট্রাম্পিয়ান নাটকীয়তা আছে, জায়নবাদীদের কাছ থেকে আন্তরিকতা ওই তুলনায় খুবই কম।

    তবে আশার কথা হলো, এবার ইসরায়েল নামের এই দখলদারি বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক প্রকল্পটি উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক বাধার সম্মুখীন হয়েছে ও হচ্ছে। এই মানবতাবিরোধী প্রকল্পের বেলুন ফুটো করেছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলি গণহত্যার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃবৃন্দের দায়ের করা মামলা। যা পরিণতি পায় ওই আদালত কর্তৃক গণহত্যা প্রমাণিত হওয়ায় ও গণহত্যা বন্ধের নির্দেশে। এরপর আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এরই জেরে গত ৬ ফেব্রুয়ারি আইসিসি-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ট্রাম্প। তার সই করা নির্বাহী আদেশে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আদালতটি যুক্তরাষ্ট্র ও এর ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে বেআইনি ও ভিত্তিহীন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

    যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ ও একঘরে করার ষড়যন্ত্র। যে দেশ ও যেসব ব্যক্তি এর সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধেও নানা উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এ গ্রেফতারি পরোয়ানায় তেমন কার্যকর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই কেননা এ অপরাধীরা যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু। কিন্তু এর নৈতিক প্রভাব অস্বীকার করবার সুযোগ নেই। কোনো কোনো দেশ এই ক্ষমতাধর গণহত্যাকারীদেরকে তাদের নিজ নিজ দেশের মাটিতে পেলে গ্রেফতার করবে বলেও ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এটি এক আদর্শিক বিজয়।

    আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিজয় হলো, এই ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে ইসরায়েলি আগ্রাসন রুখে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগঠিত হলো হেগ গ্রুপ। গ্রিক অর্থনীতিবিদ ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস, মার্কিন রাজনৈতিক নেতা বার্নি স্যান্ডার্স ও ব্রিটিশ নেতা জেরেমি করবিনদের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রোগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই গ্রুপে প্রাথমিকভাবে আছে আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার ৯টি দেশ— দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, কিউবা, হন্ডুরাস, মালয়েশিয়া, নামিবিয়া, বেলিজ ও সেনেগাল।

    দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা এ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ সম্পর্কে জোরাল মন্তব্য করেছেন এই বলে, “আন্তর্জাতিক আইনকানুনের বৃহৎ অবক্ষয় ও তা না মানার প্রবণতার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে হেগ গ্রুপ গঠন এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এটি পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছে: কোনো রাষ্ট্র আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং কোনো অপরাধকে ছাড় দেওয়া হবে না।” (এ নিউ কোয়ালিশন টু ডিফেন্ড প্যালেস্টাইন, রনি কাসরিলস, জ্যাকোবিন সাময়িকী, ২ ফেব্রুযারি ২০২৫)

    এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটির মূল প্রতিশ্রুতিগুলো হচ্ছে: ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করা, আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করতে পারে এমন কোনো অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যন্ত্রপাতি ইসরায়েলে সরবরাহে বাধা তৈরি করা এবং সামরিক অস্ত্র ও জ্বালানি বহন করা কোনো ইসরায়েলি জাহাজকে এইসব দেশের কারও বন্দরে ভিড়তে না দেওয়া।

    জ্যাকোবিন সাময়িকীর পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধে কাসরিলস আরও লিখেছেন, “ব্রিকস-এর শক্তি বৃদ্ধি এবং পৃথিবীতে একচ্ছত্র পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও চীনের চ্যালেঞ্জ, এসবের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ গোলার্ধের রাষ্ট্রগুলোকে আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে নৈতিক, মানবিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নসমূহকে কেন্দ্র করে।”

    হেগ গ্রুপের যাত্রা সম্পর্কে ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিসের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, “মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায়সঙ্গত শান্তির জন্য এই ক্যাম্পেইন, হেগ গ্রুপের এই লক্ষ্য, কেবল ফিলিস্তিনিদেরকে স্বাধীন করার জন্য নয়, এটি ইসরায়েলিদেরকেও ভয় থেকে এবং পশ্চিমা আমাদেরকেও কর্তৃত্ব, অচলাবস্থা ও যুদ্ধ থেকে মুক্ত করার জন্য। মুক্ত ইউরোপের, মুক্ত পশ্চিমের ও একটি যথার্থ পৃথিবীর জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে মুক্ত ফিলিস্তিন।”

    বিশ্বের অন্যতম সেরা দখলদার ভূমিদস্যু ট্রাম্প-নেতানিয়াহু ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের ভণ্ডামি ও গুণ্ডামি রুখে দিতে এই আন্তর্জাতিক গ্রুপটি এক অপরিহার্য পদক্ষেপ। ট্রাম্প যতই হুমকি-ধমকি দিচ্ছে ও গলাবাজি করছে এই মেয়াদে যে তার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না এ বিষয় ততই পরিষ্কার হচ্ছে। ফিলিস্তিনে অশান্তি তৈরি যে জায়নবাদী গোষ্ঠীকে শান্তিতে রাখবে না এ কথাও নিশ্চিত। হেগ গ্রুপে আরও রাষ্ট্র যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা এই আশার বার্তাই দিচ্ছে।

    সর্বশেষ

    মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ব্যাখ্যা

    বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মো. মনসুর আলী...

    ঢাকায় শিগগিরই চালু হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়

    ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিস স্থাপনের বিষয়টি চূড়ান্ত, শিগগিরই...

    জমে উঠেছে রাজধানীর পশুর হাট, ছোট গরুর চাহিদা বেশি

    জমে উঠেছে রাজধানীর পশুর হাট, ছোট গরুর চাহিদা বেশিঈদুল...

    প্রতিবেশীর গুলিতে অভিনেতা খুন

    হলিউড অভিনেতা জোনাথন জসকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।...

    আরও সংবাদ

    মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ব্যাখ্যা

    বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মো. মনসুর আলী...

    ঢাকায় শিগগিরই চালু হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়

    ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিস স্থাপনের বিষয়টি চূড়ান্ত, শিগগিরই...

    জমে উঠেছে রাজধানীর পশুর হাট, ছোট গরুর চাহিদা বেশি

    জমে উঠেছে রাজধানীর পশুর হাট, ছোট গরুর চাহিদা বেশিঈদুল...