কারুকার্য ও নির্মাণশৈলীতে মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া বাজারের ঐতিহাসিক শাহি মসজিদ। এ মসজিদ ঘিরে ঘটনার যেন শেষ নেই। কথিত আছে, ব্রিটিশ আমলে অত্যাচারী জমিদারদের ধর্মীয় গোঁড়ামি, নানান বিরোধে মাটিচাপা দেওয়া হয় মসজিদটিকে। উদ্ধারের পর তৎকালীন দিল্লির আদালতের দেওয়া রায়ে এতে নামাজ পড়ার সুযোগ পান স্থানীয় মুসলিমরা। সে সময়ে দ্বন্দ্ব-বিরোধে মৌলবি শমসের নামে একজনকে হত্যার ঘটনাও ঘটে।
জানা গেছে, ১৪৬৫ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের ইলিয়াস শাহি বংশধর নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের ছেলে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ তৎকালীন আছিয়া খাতুনের পরগনা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের মুডুপাড়া এলাকায় বেড়াতে আসেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী, মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দীন, আমীর শিহাবউদ্দীন কিরমানী, মনসুর সিরাজী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসু। মোগল রীতি অনুযায়ী বরবক শাহ আছিয়া খাতুনের পরগনায় মসজিদ নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহী মসজিদ। আছিয়া খাতুন তার পরগনা থেকে ১৮ বিঘা জমি এ মসজিদের নামে দান করেন। তাই এই মসজিদকে আছিয়া খাতুনের মসজিদ নামেও জানেন স্থানীয়রা।
কারুকার্য ও নির্মাণশৈলীর বিবেচনায় মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম এই শাহী মসজিদ। প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের পুরোনো এই মসজিদের নামকরণ বরবক শাহের নামানুসারে করা হয়। বর্গাকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪০ ফুট করে। চারপাশের দেওয়াল ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি চওড়া। পূর্বপাশে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি। কালের আবর্তে মসজিদটির দেওয়াল, ছাদে ও গম্বুজে ফাটল আর সামনের জমি বেদখলের ঘটনায় হুমকির মুখে পড়েছে মসজিদটি।
শাহি মসজিদের পাশে রয়েছে পাঁচটি কবর। এখানে শায়িত এ মসজিদের জমিদাতা পরগনার মালিক আছিয়া খাতুনও। আরেকজন মৌলভী শমসের মিয়া। বাকি তিনটি কবর স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের।
মুড়াপাড়ার জমিদারদের লোকজন একসময় শাহি মসজিদটি মাটিচাপা দেয়। এরপর প্রায় ৮০ বছর এ মসজিদ স্থানীয়রা ব্যবহার করতে পারেনি।
তবে ২০০ বছর আগে স্থানীয় মুসল্লিরা মিলিত হয়ে মাটি সরিয়ে মসজিদ উন্মুক্ত করেন। এরপর নাওড়া গ্রামের মৌলভী সমশেরসহ স্থানীয় মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে আজান দিলে জমিদারের লোকজন হাতি নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় গ্রামের মুসলমান আর হিন্দু জমিদারের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় মৌলভি শমসের মিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দড়িকান্দী গ্রামের বাসিন্দা মসজিদ কমিটির সদস্য মো. মনির হোসেন বলেন, ঐ ঘটনায় প্রথমে কলকাতার আদালতে ও পরে দিল্লির কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা হলে মামলার রায় অনুযায়ী শাহী মসজিদে মুসলমানরা ফের স্বাধীনভাবে নামাজ আদায় করার সুযোগ পান। মসজিদটি সংরক্ষণ এবং সেই সঙ্গে আছিয়া খাতুন এবং মুসলিম বীর শহিদ মৌলবি শমসের মিয়ার কবর রক্ষার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ গোলাম ফারুক খোকন বলেন, মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। মসজিদের নির্মাণশৈলী দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও এখানে ঘুরতে আসেন। তাদের অনেকে মসজিদে নামাজও আদায় করে থাকেন।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ঐতিহাসিক শাহী মসজিদের উন্নয়নে এবং সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। বর্তমান সরকার ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদের উন্নয়নে নজর দেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।