আমিরুল ইসলাম কাগজী।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে ঘুরে ফিরে একই নাটক মঞ্চস্থ করছে—“বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসনের ঢল”। দিল্লি আর বিজেপি নেতারা সংখ্যার পর সংখ্যা ছুড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে দোষারোপ করে। কিন্তু একটু খুঁজে দেখলেই বোঝা যায়, এসব সংখ্যা আসলে রাজনৈতিক গুজবের ফানুস।
১৯৯৭ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দরজিৎ গুপ্ত বলেছিলেন, ভারতে নাকি ১ কোটি বাংলাদেশি আছে। ২০০১ সালে আবার নতুন সংখ্যা—১.৫ কোটি। ২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতা বললেন ১.২ কোটি। ২০১৬ সালে বিজেপি মন্ত্রী কিরণ রিজিজু দাবি তুললেন ২ কোটি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এত বছর ধরে সংখ্যাটা কেবল বাড়ছে, অথচ কোথাও কোনো বৈজ্ঞানিক জরিপ বা অফিসিয়াল তথ্য নেই। সবই আন্দাজ, সবই রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা। ভারত সরকার বিশেষ করে মোদি এখনো পর্যন্ত প্রকাশ করল না যে তার দেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত? বাংলায় কথা বললে সেই ব্যক্তি যে বাংলাদেশী হয়ে যাবেন এমনটি নয়। বাংলা বাংলাদেশের একমাত্র ভাষা-এটা যেমন ঠিক তেমনি বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভারতের চেয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ এখানে বেশি। কাজের সন্ধানে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বরং বহু ভারতীয় নাগরিক এখন বাংলাদেশে চাকরি করে অর্থ উপার্জন করে তার দেশে পাঠাচ্ছে।
একটা হিসাবের কথা বলি, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশের সময় ধরা পড়া বাংলাদেশির সংখ্যা মাত্র ১,১১৫ জন। অথচ একই সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা ৩,১৭৩ জন। অর্থাৎ, প্রবাহটা ভারত থেকে বাংলাদেশে বেশি বাংলাদেশ থেকে ভারতে নয়।
এর পেছনে কারণও স্পষ্ট। ২০২০–২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১,৯৬২ মার্কিন ডলার, যেখানে ভারতের ছিল ১,৯৩৫ ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়ন সূচকে ভারতকে টপকে যাচ্ছে। তাহলে কেন একজন বাংলাদেশি ভারত যাবে? বাস্তবতা হলো—ভারতের দারিদ্র্য আর বেকারত্ব থেকে মানুষ পালাচ্ছে, আর বিজেপি সেটাকে আড়াল করতে “বাংলাদেশি অভিবাসন” এর ভৌতিক কাহিনি সাজাচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো—এই অপপ্রচারকে মোদি সরকার সাম্প্রদায়িক অস্ত্রে পরিণত করেছে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম বা ওডিশায় বাঙালি মুসলমানরা কেবল বাংলায় কথা বলার কারণে গ্রেফতার হচ্ছে, বৈধ আধার কার্ড বা ভোটার আইডি দেখিয়েও নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারছে না। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, বাংলাভাষী মুসলমানদের “বাংলাদেশি” তকমা লাগিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে।
মাত্র কয়েকদিন আগের কথা।২৯ জুলাই দিল্লি পুলিশ বাংলাভাষী কয়েকজনকে আটক করে। তাদের ব্যাপারে জানতে দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের এক পান্থশালার কর্মকর্তাকে একটি চিঠিতে বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ হিসেবে উল্লেখ করে। তাতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশি ভাষা বলা কলঙ্কজনক, অপমানকর, দেশবিরোধী এবং অসাংবিধানিক কাজ। এটি ভারতের সব বাংলাভাষী মানুষকে অপমান করে। তারা আমাদের হেয় করে চিঠিতে এমন ভাষা ব্যবহার করতে পারে না।’
দিল্লির পুলিশ যে চিঠিতে বাংলাকে বাংলাদেশি ভাষা বলেছে, সেটি বাংলাভাষী কয়েকজনকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে একটি এফআইআর তদন্ত করতে গিয়ে লিখেছিল। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দিল্লিতে যে পান্থশালা আছে, সেখানকার কর্মকর্তাদের সাহায্য চাইতেই ওই চিঠি। কিন্তু তার মাসখানেক আগে থেকে মমতা বাংলাভাষী ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন।
দিল্লিতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের রাজ্য বিধানসভার আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘু মুসলমান বাংলাভাষীদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে যে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে, তাতে বহু ভারতীয় নাগরিক অন্যায় বাস্তুচ্যুতি ও দেশান্তরির শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
মমতা তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সরকার বেশ কয়েকটি ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে এ রকম জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া বা পুশ ইন করা কয়েকজনকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। মোদি সরকারের বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে বাংলা ভাষাভাষী নাগরিকদের পুশ ইন করার তৎপরতা ভারত থেকেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে ন্যায্যভাবে।
ভারত সব সময় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বাংলাদেশকে শত্রু বানানোর চেষ্টা চালায়। অথচ সত্যি হলো, বাংলাদেশ কারও বোঝা নয়। বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন, আত্মমর্যাদা আর সম্ভাবনার প্রতীক। দিল্লি যতই গুজব ছড়াক না কেন, বিশ্ববাসী জানে—তথ্য প্রমাণ সবই বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলছে। খোদ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কথা থেকেই সেটা স্পষ্ট। বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারতে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ কোটির কম নয়। এরমধ্যে কতজনকে তারা বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাবে?
বাংলাদেশ কখনোই ভারতের কল্পিত “অবৈধ অভিবাসনের” দায় নেবে না। বরং এখন সময় এসেছে সোজা ভাষায় বলে দেওয়ার—আমরা স্বাধীন, আমরা আত্মনির্ভরশীল, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধির নতুন প্রতীক। আর দিল্লির হিন্দুত্ববাদী মিথ্যাচার বাংলাদেশের মর্যাদাকে কখনোই খর্ব করতে পারবে না।