আব্দুল রশিদের বয়স ৩৫ বছর। কিন্তু এনআইডি অনুসারে, তার বয়স ১০৪ বছর। ফলে রশিদের বয়স হয়ে গেল তার বাবার চেয়েও ৫৩ বছর বেশি!
নেত্রকোনার দুর্গাপুরে নিজের একটি নতুন বাড়ি হবে―এমন সাধারণ স্বপ্নই ছিল আব্দুল রশিদের। কিন্তু এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলেই বাধে বিপত্তি। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যখন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যাচাই করার পালা এলো, তখনই সব ভেস্তে গেল।
আব্দুল রশিদের বয়স ৩৫ বছর। কিন্তু এনআইডি অনুসারে, তার বয়স ১০৪ বছর। ফলে রশিদের বয়স হয়ে গেল তার বাবার চেয়েও ৫৩ বছর বেশি!
দুর্ভাগ্যবশত, এ ঘটনা কিন্তু শুধু রশিদের সঙ্গেই ঘটেনি। বাংলাদেশি হয়ে আপনার এনআইডিতে যদি কোনো ভুল না থাকে, তাহলে আপনি দেশের সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তিদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন।
নাগরিকদের নির্ভুল ও নিরাপদ পরিচয়পত্র দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো তাদের জীবনকে সহজ করা। এর পরিবর্তে, এই এনআইডি প্রদান ব্যবস্থাই হয়ে উঠেছে মাথাব্যথার কারণ। বানান ভুল থেকে শুরু করে হাস্যকর জন্মতারিখ, ভুল পারিবারিক সম্পর্কসহ আরও নানা ভুল এখন এতটাই স্বাভাবিক যে এগুলো হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যার এনআইডিতে ভুল থাকে, তাদের জন্য কিন্তু বিষয়টি মোটেও হাস্যকর নয়।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ৭৫ বছর বয়সী মোসলিম উদ্দিনের এনআইডিতে বয়সের ভুল থাকায় বয়স্ক ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তার কার্ড অনুসারে, তিনি ১৯৫৯ সালের ২৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ কার্ড অনুসারে তার বয়স ৬৬ বছর। মোসলিম উদ্দিন তার ১৯৬৩ সালে জন্ম নেওয়া ছেলের চেয়ে মাত্র চার বছরের বড়!
মোসলিম বলেন, “আমি বিভিন্ন সাহায্য সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই জীবনযাপন করি। কিন্তু এই ভুলের কারণে আমার যেটা প্রাপ্য, তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি।”
এই ভুল সংশোধনের জন্য তিনি নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার কম্পিউটার অপারেটর তার কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ দাবি করেন।
রাঙ্গুনিয়ার নুরুল ইসলাম বলেন, তার এনআইডিতে মায়ের নামের জায়গায় তার স্ত্রীর নাম লেখা আছে। “আমি কয়েক বছর আগে এটি সংশোধনের জন্য আবেদন করেছি, কিন্তু এখনও এর সমাধান হয়নি। আমার এনআইডি অনুসারে, আমার স্ত্রী এখন আমার সন্তানদের দাদি। ব্যাপারটা হাস্যকর।”
ঘটনাগুলো হাস্যকর হলেও এসব ভুল তাদের দৈনন্দিন জীবনে ও সন্তানদের শিক্ষাগত অসিফিয়াল নথিতে বড় সমস্যা তৈরি করছে।
পাবনার ঈশ্বরদীর বাদল সরকার কখনো কল্পনাও করেননি, একটা সাধারণ টাইপো তার জন্য এমন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে। এনআইডিতে তার নাম ভুল করে লেখা হয়েছিল ‘বাদল ডার্কার’ (Badal Darker)। এই ভুল সংশোধনের জন্য তিনি অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সে সময় তার আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়।
ভুলটি সংশোধন করার জন্য তিনি ঢাকার নির্বাচন কমিশনের পুরো কার্যালয়ে চক্কর দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান না করে শুধু একটি স্বাক্ষর নিয়ে তাকে পাবনার স্থানীয় অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে হাল ছেড়ে দিয়ে বাদল অবশেষে ‘শর্টকাট’ পথ―দালাল― ধরেন।
দালাল প্রথমে বাদলের কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করে। দর কষাকষি করে শেষ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকায় এনআইডি সংশোধন করান তিনি।
বাদল বলেন, ‘ঢাকা-পাবনা দৌড়াদৌড়ি করে করে একদিন চলে যাচ্ছিলাম। তখন একজন দালাল আমাকে একদিনে সবকিছু ঠিক করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি জানতাম, এটা সঠিক পথ না। কিন্তু সত্যি বলতে, আমার এ ঢাকা-পাবনার চক্র কবে শেষ হবে আমি জানতাম না। তাই এ পথ ধরেছি।”
রংপুরের আল আমিনের এনআইডিতে টাইপোর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ২০১৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করেও এখনও স্মার্ট কার্ড পাননি তিনি। কয়েক বছর অপেক্ষা করার পর তিনি ওয়েবসাইট থেকে তার এনআইডি প্রিন্ট করে লেমিনেটিং করে নেন।
আল আমিন বলেন, “আমি বছরের পর বছর অপেক্ষা করছিলাম। সাত বছর ধরে শুনছি, নির্বাচনের আগে স্মার্ট কার্ড আসবে। কিন্তু দুটি নির্বাচন হয়ে গেছে, এখনও আমার স্মার্টকার্ড পাইনি।”
নাম না প্রকাশের শর্তে নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের কাছে পর্যাপ্ত স্মার্ট কার্ড নেই। নির্বাচনের আগে আমরা নির্দিষ্ট এলাকায় সেগুলো ইস্যু করি, কিন্তু নতুন ব্যাচ এলেও সংশোধনের অনুরোধের ব্যাপক চাপের কারণে সেগুলো যথেষ্ট নয়।”
গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন খাতে বড় ধরনের সংস্কারের আশা ছিল। কিন্তু এনআইডি পরিষেবার ক্ষেত্রে কিছুই পরিবর্তন হয়নি। আগের চেয়েও নির্ঝঞ্ঝাট আর দক্ষ প্রক্রিয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও নাগরিকরা এখনও একই সমস্যা মোকাবিল করে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, বর্তমানে চার ক্যাটাগরিতে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮০০টির বেশি এনআইডি সংশোধনের আবেদন অপেক্ষমাণ অবস্থায় আছে। প্রক্রিয়াটি যন্ত্রণাদায়ক রকমের ধীর। সেইসঙ্গে আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আবেদনকারীকে হও অনলাইনে আবেদন করে এনআইডি ওয়ালেটের মাধ্যমে চার্জ জমা দিতে হয়, অথবা ক্লান্তিকর ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাজ করতে হয়। এরপরও প্রত্যাখ্যানের হার বেশি। আর ম্যানুয়াল আবেদন করে মাসের পর মাস মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে।
অনেকের কাছে বাদল যা করেছেন, সেটাই একমাত্র আসল সমাধান মনে হয়। দালালকে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক দিয়ে একদিনের মধ্যেই কাজটা করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু একটি মৌলিক পরিচয়পত্র সংশোধন করা কি সত্যিই এতটা কঠিন হওয়া উচিত?
ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং নতুন এনআইডি আবেদন প্রক্রিয়ার সময় জনবলের অভাবের অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) অস্থায়ীভাবে আবেদনকারীর তথ্য সংগ্রহ করতে এবং তাদের জন্য আবেদন ফাইল করতে স্কুল শিক্ষকদের নিয়োগ করেছে।
পাবনার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান বলেন, “এ কাজের জন্য আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। একই দিনে ছবি ও আঙুলের ছাপের জন্য শত শত মানুষ এসে অপেক্ষা করে। সেখানে ভুল হতে বাধ্য।”
অনেক ক্ষেত্রে, দালাল ও মধ্যস্থতাকারীরা পরিস্থিতির ফায়দা নিয়ে দ্রুত কাজ করে দেওয়ার অতিরিক্ত ফি আদায় করে। বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এনআইডি সিস্টেমও অদক্ষতা ও দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে।
তবে সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার এই নিবন্ধন পরিষেবাগুলো সংগঠিত করতে একটি নতুন ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছে। সিভিল রেজিস্ট্রেশন অর্ডিন্যান্স, ২০২৫ নামক খসড়া আইনে একটি একক সংস্থার অধীনে জন্ম নিবন্ধন এবং এনআইডি পরিষেবাগুলোকে একীভূত করার জন্য একটি ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন কমিশন’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছে।
কিন্তু প্রস্তাবটি বিতর্ক ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা এনআইডি পরিষেবা তাদের অধীনের রাখার দাবি জানিয়েছেন। এ দাবিতে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি ও বিক্ষোভ পালন করেছেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি-র সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি যে এনআইডি পরিষেবা ইসির অধীনেই থাকা উচিত। কারণ আমরা ২০০৭ সাল থেকে এই সিস্টেমটি তৈরি করছি। আমাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা আছে এবং আমরা প্রয়োজনীয় পরিষেবাও সরবরাহ দিচ্ছি।”
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এনআইডি পরিষেবা নিজেদের অধীনে রাখার জন্য সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে ইসি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের আরেক কর্মকর্তা জানান, “ইসি থেকে এনআইডি সেবা সরিয়ে নেওয়া হলে তারা তাদের আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হারাবে। সংশোধন আবেদনের ফি থেকে ইসি মোটা অঙ্কের টাকা পায়। তার চেয়েও বড় কথা, কর্মচারীরা দালাল সিন্ডিকেটের কাছ থেকে যে পার্সেন্টেজ পায়, তা হারাবে। দালালদের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি কর্মী সপ্তাহে প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা করে পান।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান বলেন, “জন্ম নিবন্ধন এবং এনআইডি পরিষেবা যদি একটি একক সংস্থার অধীনে একীভূত করা হয়, তবে তথ্য আপডেট করা আরও কার্যকর হবে। কারণ তারা একই ডেটাবেজে সব কাজ করতে পারবে। বর্তমানে দুটি আলাদা সংস্থা এসব তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে, যার কারণে ত্রুটি থেকে যায়।”
তিনি সমস্যাটির মূলে জবাবদিহি ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবও রয়েছে বলে মনে করেন।
সাদিক হাসান বলেন, “প্রাথমিক আবেদনের প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি ত্রুটিপূর্ণ। তথ্য সংগ্রহের সময়ই ভুলগুলো হয় এবং এ বিষয়ে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নাই। আর যেহেতু কোনো জবাবদিহি নেই, তাই ভুলেরও কোনো সীমা নেই।”
একটি এনআইডি সংশোধনের খরচ শুধু আর্থিক নয়। সংশোধনের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন নথিরও প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি জন্ম তারিখ সংশোধনে জন্য এসএসসি সার্টিফিকেট বা জন্মসনদের সত্যায়িত কপি প্রয়োজন হয়৷
নাম সংশোধনের জন্য, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে হলফনামা এবং সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় নথি জমা দেওয়ার পরেও আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার ও বিভিন্ন বিষয় তদন্তের জন্য ডাকা হয়। যার কারণে প্রক্রিয়াটি কয়েক মাস, কখনও কখনও কয়েক বছর পর্যন্ত গড়ায়।
এই বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ডক্টর মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “কাজের চাপ অপরিসীম, কিন্তু কর্মী সংখ্যা সীমিত। এর ফলে যে ভুলগুলো হয় যা চেক করা যায় না। প্রক্রিয়ায় আরও বেশি কর্মী যুক্ত হলে ভুলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব এবং সময়ও কমবে।”