আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় এ হিসাবে ২০২০ সালের অগাস্ট থেকে সীমার অতিরিক্ত লেনদেন হলেও এতদিন প্রশ্ন তোলা হয়নি; এখন ’সন্দেহজনক’ বলেছে ব্যাংকটি।
পেশায় তিনি অফিস সহকারী, মাসের আয় ৪০ হাজার টাকা। এমন এক ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে প্রায় সাড়ে চার বছরে জমা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা, তোলা হয়েছে সাড়ে ২০ কোটি।
একবারে সর্বোচ্চ জমা দেওয়া হয়েছে সাড়ে চার কোটি টাকা; আর একবারে সর্বোচ্চ স্থানান্তর করা হয়েছে ২ কোটি ৩৪৫ টাকা। আবার একদিনে আটবারে ৩ কোটি টাকাও জমা পড়েছে।
২০২০ সালের ১৯ অগাস্ট আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেডের কারওয়ান বাজার শাখায় খোলা এ হিসাবে দীর্ঘ সময় ধরে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত লেনদেন হলেও এতদিন প্রশ্ন তোলা হয়নি; যা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সামনে এনেছেন ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বড় অঙ্কের এসব লেনদেনকে এখন ’সন্দেহজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিএফআইইউকে তথ্য দিয়েছে ব্যাংকটি। চিঠি পাওয়ার পর আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে পরিচিত সংস্থাটি তা তদন্ত করার কথা বলেছে।
হিসাবধারী এই ব্যক্তির নাম মোবারক হোসেন, যিনি রাহাত খলিল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামে রাজধানীর একটি ল ফার্মের অফিস সহকারী।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যখন এ সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করে তখন মোবারক হোসেনের ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৪ কোটি ২৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা (১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪)।
তার ব্যাংক হিসাবের তথ্য বলছে, শুরু থেকে ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বেশি জমা পড়েছে। আর চার বছর চার মাসে ২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা তোলা হয়েছে।
এর মধ্যে চেকের মাধ্যমে ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর একক লেনদেনে সর্বোচ্চ সাড়ে চার কোটি টাকা জমা হয়। অপরদিকে ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল একই দিনে ৮ বার মিলে চেকের মাধ্যমে মোট ৩ কোটি টাকা জমা পড়ে। ২০২৪ সালের ১৪ মার্চ ২ কোটি ৩৪৫ টাকা স্থানান্তর করা হয়।
ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, অ্যাকাউন্ট খোলার সময় ওই ব্যক্তি চাকরির পাশাপাশি জমি কেনাবেচা ও শেয়ার ব্যবসার কথা বললেও পরে এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য দেননি। বড় লেনদেনগুলোর সময় অর্থের উৎস সম্পর্কেও তথ্য নেওয়া হয়নি।
সরকার বদলের পর বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১১ বছরের পুরনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক বিন আব্দুল্লাহর মেয়াদ নবায়ন করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তাকে সরিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মজিবুর রহমানকে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই হিসাবে ‘সন্দেহজনক’ লেনদেনের বিষয়টি বিএফআইইউকে অবহিত করেন।
গত ৭ জানুয়ারি এসব লেনদেনকে ’সাসপিশাস ট্রানজেকশন রিপোর্ট’ (এসটিআর) হিসেবে শনাক্ত করে তিনি আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সং স্থা হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) তদন্তের জন্য চিঠি দেন।
চিঠিতে বলা হয়, “কেওয়াইসি (গ্রাহকের পরিচিতি) অনুযায়ী হিসাবধারী পেশায় একজন চাকরিজীবী হলেও নিয়মিতভাবে ট্রানজেকশন সীমার অতিরিক্ত লেনদেন করেছেন, যা সন্দেহজনক বলে প্রতীয়মান হয়।
”এ বিষয়ে শাখা থেকে কোনো রকম সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করা হয়নি এবং বিষয়টি তদন্ত করার জন্য বিএফআইইউকে দাখিল করা হয়নি।”
ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিএফআইইউকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডি মজিবুর রহমান বলেন, “আমি এ ব্যাংকে আসার পর এ রিপোর্ট পাঠিয়েছি। বিএফআইইউকে বিষয়গুলো যাচাই করতে বলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সেটা বিএফআইইউকে জানাতে হয়।
“এ বিষয়ে বিএফআইইউর সঠিক তদন্ত করা উচিত। কারণ বিষয়টি ঠিক, না বেঠিক সেটা অনুসন্ধান করতে হবে। যদি এটা ভায়োলেশন হয়, তাহলে আইসিবির ক্যামেলকো কেন বিষয়টি দেখেন নাই, এটার দায়িত্ব আইসিবির আগের ম্যানেজমেন্টকেও নিতে হবে।”
এ অ্যাকাউন্টে চেকের মাধ্যমে টাকা কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় গেছে তা যাচাই করলে অস্বাভাবিকতার বিষয়টি বিএফআইইউর তদন্তে বেড়িয়ে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিএফআইইউ প্রধান এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, “আমাদের কাজই হচ্ছে সন্দেহজনক লেনদেন নিয়ে কাজ করা। কোনো স্পেসিফিক তথ্য আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করি না। তবে এমন কোনো তথ্য এলে সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে।“
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অ্যাকাউন্টধারী রাহাত খলিল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের অফিস সহকারী (পিওন) মোবারক হোসেন বলেন, এটি তারই অ্যাকাউন্ট।
”তবে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডি শফিক বিন আব্দুল্লাহকে টাকা দিয়েছিলেন স্যার (রাহাত খলিল)। কারণ সে সময় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কর্মচারীদের ঈদের আগে বেতন দেওয়ার মত টাকা ছিল না। তাই স্যার সেসময় আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পাঠিয়েছিল। বাকি আমি কিছু বলতে পারব না।”
১৬ ‘সন্দেহজনক’ লেনদেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো ’সন্দেহজনক’ লেনদেনের চিঠির তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৬টি ‘সন্দেহজনক’ লেনদেন শনাক্ত করা হয়েছে।
ওই সময়ে এ হিসাবে ২১ বারে জমা হয় মোট ১৩ কোটি ৮০ লাখ ২১ হাজার টাকা এবং ৩৯ বারে তোলা বা অন্যত্র স্থানান্তর করা হয় ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
সন্দেহজনক লেনদেনের মধ্যে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ লেনদেন করা হয়; তিনবারে জমা করা হয় ২ কোটি ৬০ লাখ ২১ হাজার টাকা এবং সাতবারে তোলা হয় ৩ কোটি ৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা।
এসটিআর (সন্দেহজনক লেনদেন) হিসেবে চিহ্নিত ১৬টি লেনদেনের মধ্যে ২০২২ সালের মে মাসে দুইবারে তিন কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালের এপ্রিলে আটবারে ৩ কোটি জমা দেওয়া হয়।
অপরদিকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বেরে তিনবারে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০২৪ সালের মার্চে তিনবারে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৫১ হাজার টাকা তোলা হয়।
নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে বারবার এ অ্যাকাউন্টে লেনদেন হলেও ব্যাংকটির আগের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে কোনো রকমের তথ্য দেয়নি। অথচ এরকম লেনদেন হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করার নিয়ম রয়েছে।
সীমার অতিরিক্ত লেনদেন
এ হিসাব খোলার দিন থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোবারক হোসেনকে জমা হওয়ার সর্বোচ্চ সীমা (টিপি লিমিট) দেওয়া হয় ৫৯ লাখ টাকা। অথচ এ সময়ে তার হিসাবে জমা হয় ১৩ কোটি ৮০ লাখ ২১ হাজার টাকা।
আর এ সময়ে স্থানান্তর বা ওঠানোর সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে এ সময়ের মধ্যে স্থানান্তর বা ওঠানো হয় ১৩ কোটি ৭ লাখ ২২ হাজার টাকা।
পরে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মোবারক তার লেনদেন সীমা বাড়িয়ে নেন। ব্যাংক তখন সর্বোচ্চ সীমা দেয় ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর স্থানান্তরের বেলায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তিন মাস পর মার্চে এ সীমা ভেঙে তাকে ২ কোটি ৬৭ লাখ ৫১ হাজার টাকা লেনেদেনের সুযোগ দেওয়া হয়।
আইসিবি ইসলামিকের ‘বেতন দিতে’ টাকা লেনদেন?
মোবারক হোসেনের কর্মস্থল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে রাহাত খলিল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে গিয়ে তার অ্যাকাউন্টে বড় অঙ্কের লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, তার অ্যাকাউন্ট থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ‘বেতন দেওয়ার জন্য’ টাকা জমা দিয়েছিলেন তার ’বস’ রাহাত খলিল।
এ বিষয়ে নিজে আর বেশি কিছু জানেন না বলে মোবারক দেখিয়ে দেন আইনজীবী রাহাত খলিলকে; যিনি রাহাত খলিল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। আইন বিষয়ক এই পরামর্শক সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।
মোবারকের দাবির বিষয়ে প্রশ্ন করলে রাহাত খলিল বলেন, ২০০৩ সাল থেকে তিনি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়লে তিনিও বেতন পাচ্ছিলেন না।
“রোজার ঈদের আগে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক কর্মীদের বেতন দিতে পারছিল না। তখন আমি দেড় কোটি টাকা অন্য জায়গা থেকে ম্যানেজ করে দিই। আমি তখন তাদের টাকা দিয়েছিলাম কিন্তু তাদের তারল্য সংকট থাকার কারণে এই টাকা দিতে পারেনি আমাকে।
“এমডি শফিক বিন আব্দুল্লাহ আমার কাছে বিভিন্ন সময় টাকা ধার চেয়েছিলেন। তাকে টাকা ধার দিয়েছিলাম।”
কেন মোবারক হোসেনের অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া হল এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “শফিক বিন আব্দুল্লাহ গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে দিতে বলেছিল। কারণ গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে দিলে ফান্ড বাড়বে।”
রাহাত খলিল আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গেও কথা বলেন এ সময়। তার দাবি শফিক বিন আব্দুল্লাহকে ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তা পদত্যাগে ‘বাধ্য’ করেছেন।
ব্যাংকের কর্মীদের বেতনের জন্য তিনি দেড় কোটি টাকা ‘টাকা ধার দেওয়ার’ দাবি করলেও মোবারকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচবারে জমা হয় ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ওই বছর রোজার ঈদ হয় ১০ এপ্রিল।
সাবেক এমডি শফিক বিন আব্দুল্লাহ’র সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার দাবি করে রাহাত খলিল বলেন, “কোভিডের পর ব্যাংক তারল্য সংকটের মধ্যে পড়লে সে সময় শফিক বিন আব্দুল্লাহ আমার কাছে টাকা ধার চেয়েছিলেন। এরপর আমি বিভিন্ন সময় তাকে টাকা ধার দিয়েছি।”
তার দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বর্তমান ‘ম্যানেজমেন্ট’ তার ও শফিক বিন আব্দুল্লাহের সঙ্গে ‘ষড়যন্ত্র’ করছে। তাকে ‘ফাঁসানোর’ চেষ্টা করছে।
এমডি হিসেবে মেয়াদ নবায়ন না হলে নিজ দেশ মালয়েশিয়ায় ফিরে যান শফিক বিন আব্দুল্লাহ। এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, রাহাত খলিলের কাছে আমি আড়াই কোটি টাকা (ডিপোজিট) চেয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে দিয়েছিলেন।”
বাকি ২২ কোটি টাকা তাহলে মোবারকের অ্যাকাউন্টে কীভাবে জমা হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আপনি কেন আমাকে ফোন করেছেন?”
এ কথা বলে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তিনি লাইন কেটে দেন।