আমিরুল ইসলাম কাগজী
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (DUCSU) নির্বাচনের ফলাফল শুধু একটি ক্যাম্পাসভিত্তিক ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের এক বড় রূপান্তরের প্রতীক। ইসলামী ছাত্রশিবির (ICS)-এর ২৩টি আসনে জয় দেখিয়েছে, তরুণ ভোটাররা আর পুরনো রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতার কাছে আস্থা রাখতে চায় না। অথচ এই ফলাফল ঘোষণার পর ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল তড়িঘড়ি আতঙ্ক—শশী থারুরের “worrying” মন্তব্য হোক বা দিল্লির কূটনৈতিক মহলের উদ্বেগ, সবই প্রকাশ করে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ভয়: বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত যদি ভারতের কাঙ্ক্ষিত পথে না যায়, তবে তা তারা “ঝুঁকি” হিসেবে গণ্য করে।
কিন্তু এই মানসিকতা আসলে ভারতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির এক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাকে তুলে ধরে। দিল্লি বরাবরই বাংলাদেশকে তার “প্রভাব বলয়” ভেবে এসেছে, যেখানে প্রতিবেশীর ইচ্ছা, স্বপ্ন বা ক্ষোভকে গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে নিজেদের ভূরাজনৈতিক এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিয়েছে। হাসিনা সরকারের এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত শুধু নীরব দর্শক নয়, বরং সক্রিয় সমর্থক ছিল—যখন গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিরোধী দমন, এমনকি ভোট কারচুপির মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে। তাই আজ যখন তরুণ প্রজন্ম বিকল্প খুঁজছে এবং নতুন শক্তিকে জায়গা দিচ্ছে, তখন ভারতের আতঙ্কের আসল উৎস হলো প্রভাব হারানোর ভয়।
আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, ICS-এর বিজয় কোনো ধর্মতান্ত্রিক উত্থানের সংকেত নয়; বরং এটি “স্ট্যাটাস কো-র” বিরুদ্ধে এক প্রতীকী বিদ্রোহ। হাসিনার দমননীতি ও বিএনপির আত্মবিধ্বংসী রাজনীতির ব্যর্থতার মাঝখানে শিবির এক প্রকার “অপরীক্ষিত বিকল্প” হিসেবে জায়গা পেয়েছে। ভারতের কাছে এটি “চরমপন্থা” মনে হলেও, বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের কাছে এটি বাস্তব সমস্যার সমাধানের দাবি—হল, নিরাপত্তা, শিক্ষার্থীদের অধিকার। এখানেই ভারত এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে ফাঁক তৈরি হয়েছে।
যুবসমাজ ভারতের সেই “পিতৃতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর”কে ক্রমশ প্রত্যাখ্যান করছে, যা তাদের ভোটকে “উদ্বেগজনক” বলে আখ্যা দেয়। কারণ তারা মনে করে, তাদের আন্দোলন, তাদের ভোট ভারতের অনুমোদনের জন্য নয়। এই প্রজন্ম দেখে, দিল্লি শুধু হাসিনার দমনপীড়নের সহযোগী ছিল, অথচ সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে অরাজি। ফলে ভারতের প্রতি অবিশ্বাস আরও গভীর হয়েছে।
এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—বাংলাদেশ এখন আর বাইরের ইঙ্গিত নয়, বরং ভেতরের গণতান্ত্রিক তাগিদে নিজের পথ খুঁজছে। ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে “ঝুঁকি” হিসেবে নয়, বরং “বাস্তবতা” হিসেবে মেনে নেওয়া। যদি ভারত অংশীদারিত্ব, সম্মান আর পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়তে না শেখে, তবে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ভারতের কণ্ঠস্বর নয়, নিজেদের কণ্ঠই ভবিষ্যতের নিয়ামক করবে।