মালয়ালম তারকা ফাহাদ ফাসিল বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয়। ওটিটি তাঁর অভিনীত সিনেমা আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাবটাইটেল তৈরি করেন ভক্তরা। তাঁর সিনেমা মানেই যেন ভিন্নধর্মী কিছু। ফাহাদ ফাসিলকে এবার পাওয়া গেল তামিল সিনেমা ‘মারিসান’-এ। সুদীশ শংকরের সিনেমাটি গত ১৫ জুলাই মুক্তি পায় প্রেক্ষাগৃহে। তবে ২২ আগস্ট ওটিটিতে মুক্তির পর থেকেই বাংলাদেশে আলোচনায় ড্রামা-থ্রিলার সিনেমাটি। তবে এবার কি ফাহাদ ফাসিল পারলেন মন ভরাতে?
গল্প কী নিয়ে
জেল থেকে বেরিয়েই দয়া (ফাহাদ ফাসিল) আবার নেমে পড়ে চুরিতে। মোবাইল, পার্স, মোটরবাইক—এগুলোতে তার আর আগ্রহ নেই; সে চাইছে বড় শিকার। একদিন ঢুকে পড়ে এক বাড়িতে, যেখানে দেখে জানালায় হাতকড়া পরা বৃদ্ধ ভেলাইউধাম পিল্লাইকে (বাডিভেলু)। দয়ার হুমকিতে ভয় পেয়ে ভেলাইউধাম বলে ঘরে টাকা নেই, তবে এটিএম থেকে তুলতে পারে। দয়া তাঁকে নিয়ে সদ্য চুরি করা মোটরবাইকে করে বেরিয়ে পড়ে।
কিন্তু মুশকিল হলো ভেলাইউধাম আলঝেইমারে আক্রান্ত। কখনো ছেলের নাম ভুলে যায়, কখনো এটিএম পিন। কখনো আবার দয়াকেই নিজের ছেলে ভেবে বসে।
এই অনিশ্চয়তার ভেতরেও দয়া তাঁর সঙ্গ ছাড়ে না। কারণ, সে জেনে যায়, অসহায় বৃদ্ধের অ্যাকাউন্টে ২৫ লাখ রুপি আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর মনে হয়, আপাতদৃষ্টে অসহায় মনে হওয়া ভেলাইউধাম কি আসলেই অসহায়? নাকি তিনি কিছু লুকাচ্ছেন? এদিকে প্রকাশ্যে আসে একের পর এক খুনের ঘটনা। এসব ঘটনার সঙ্গে দয়া আর ভেলাইউধামের কি কোনো সম্পর্ক আছে? নাকি তাদের দক্ষিণ ভারতের প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়ানো স্রেফ রোড ট্রিপ?
সেই পুরোনো ছক
ইদানীং ভারতীয় চলচ্চিত্রে নানাভাবে উঠে এসেছে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, শিশু নির্যাতনের ঘটনা। বিশেষ করে দক্ষিণি থ্রিলার সিনেমায় বহুল আলোচিত গল্প এটি। নারী মানেই যেন ট্রমা, নির্যাতন আর আত্মহত্যার ছক—এই পুরোনো ফর্মুলা আবারও ফিরে এসেছে ‘মারিসান’-এ। ‘মহারাজা’ বা ‘ভেট্টাইয়ান’-এর মতোই এখানে নারী প্রবেশ করেছেন কেবল সহিংসতার শিকার হয়ে। পরিচালক সুদীশ শংকর ও লেখক ভি কৃষ্ণ মূর্তিও এই বিষয়কে গল্পের হাতিয়ার করেছেন, কিন্তু নতুনভাবে তুলতে ধরতে পারেননি
নামের সঙ্গে গল্পের অমিল
রামায়ণের রাক্ষস মারীচের নামে নামকরণ, কিন্তু ছবির অর্ধেক কেটে যায় একধরনের হালকা কমেডি ভঙ্গিতে, যেখানে এক চোর আর এক বৃদ্ধের যাত্রাই গল্পের কেন্দ্র। লেখক ভি কৃষ্ণ মূর্তি আর পরিচালক সুদীশ শংকর সেই বৃত্তেই এত ঘুরপাক খান যে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে।
সুযোগ নষ্ট
বিরতির আগে ভেলাইউধামের পরিচয় যখন ক্রমশ প্রকাশ্যে আসে, সে অংশটিও দেখানো হয়েছে অতি সাধারণভাবে। দর্শক তখন রোড ড্রামা থেকে ছবির বাঁকবদল নিয়ে রোমাঞ্চিত কিন্তু নির্মাতা সেই অংশটি তুলে ধরেছেন দায়সারাভাবে। ছবিতে ফাহাদ ফাসিল আর বাডিভেলুর পর্দার রসায়ন দারুণ জমেছিল, অনেক সময়ই ‘রেইন-ম্যান’ সিনেমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে ভাবতে ভাবতেই থ্রিলার মোড় নিয়ে অন্য পথে হাঁটে ‘মারিসান’।
অনেক দুর্বলতা থাকলেও ‘মারিসান’ টিকে আছে শুধু ফাহাদ ফাসিল আর বাডিভেলুর অভিনয়ের ওপর ভর করে। দুজনই চরিত্রের ভেতর দারুণভাবে মিশেছেন, তাঁদের রসায়ন ছবিকে বাঁচিয়েছে অনেকটা।
সুদীশ শংকরের দীর্ঘ টিভি সিরিয়ালের অভিজ্ঞতা যেন ছবির নির্মাণে এসে ভর করেছে। ক্লাইম্যাক্সে যে মারামারির দৃশ্য আছে, যা প্রচণ্ড দুর্বল। এই সময়ে এসে অ্যাকশন দৃশ্যে এতটা অযত্নের ছাপ থাকতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
অভিনয়ই একমাত্র শক্তি
অনেক দুর্বলতা থাকলেও ‘মারিসান’ টিকে আছে শুধু ফাহাদ ফাসিল আর বাডিভেলুর অভিনয়ের ওপর ভর করে। দুজনই চরিত্রের ভেতর দারুণভাবে মিশেছেন, তাঁদের রসায়ন ছবিকে বাঁচিয়েছে অনেকটা। কিন্তু গল্প, লেখনী আর পরিচালনায় যে অগভীরতা, তা থেকে ছবিকে টেনে তুলতে পারেননি তাঁরা। ভেলাইউধামের সংলাপ—‘স্মৃতিই জীবন’, মনে দাগ কাটে। ফাহাদ ফাসিলের কথা তো নতুন করে বলার নেই; কেবল চোখের এক্সপ্রেশন দিয়েই অতিসাধারণ দৃশ্যকে উপভোগ্য করে তুলতে পারেন।
সিনেমার প্রথমার্ধ বেশ উপভোগ্য—এক চোর আর বৃদ্ধের রোড ট্রিপে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা সহজেই মনে দাগ কাটে। কিন্তু সিনেমাটি যখনই থ্রিলারে রূপ নেওয়ার চেষ্টা করে, তখনই হোঁচট খায়। তাই ফাহাদ ফাসিল আর বাডিভেলুর দুর্দান্ত অভিনয় সত্ত্বেও ‘মারিসান’-এর রোড ট্রিপ হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর।