আমিরুল ইসলাম কাগজী
শেখ হাসিনা এখন দিল্লিতে আশ্রিত—এ দৃশ্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিছক সফর নয়, এক বেদনাদায়ক সত্য। এটা এখন আয়নার মত স্বচ্ছ পরিষ্কার যে তার ক্ষমতার শিকড় বাংলাদেশের মাটির গভীরে নয়, বরং ভারতের করুণার ওপর ঝুলে আছে। জনগণের রুদ্ররোষে প্রাণভয়ে পালিয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি, বন্দিশালায় দমনপীড়ন, আয়না ঘরে নিয়ে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং সর্বশেষ গত জুলাই -আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় নিরিহ ছাত্র জনতা হত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। অথচ তিনি এখন সীমানা পেরিয়ে ভারতের রাজধানীতে বসে আছেন পরম আত্মীয়ের মত। জনগণের চোখে এটি কোনো কূটনীতি নয়, এক নির্মম নাটক—যেখানে বার্তাটি পরিষ্কার: তিনি ঢাকা নয়, দিল্লির ছায়ায় শক্তি খোঁজেন। বিগত দিনগুলোতে একই কাজ করেছেন তিনি।
২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার নাটকের প্রথম অংক। জনগণের ভোট দেওয়া ছাড়াই ২০১৪ সালে গঠন করা হয় সরকার। তীব্র প্রতিরোধের মুখে সেদিন নাটকের দ্বিতীয় অংক মঞ্চস্থ করে বলেছিলেন এটা সংবিধান রক্ষার নির্বাচন, অচিরেই মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকারকে টেনে নিয়ে যান পাঁচ বছর।
২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল সেই নাটকের তৃতীয় অঙ্ক। এ সময়ের মধ্যে বিএনপি’র হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো, বেগম খালেদা জিয়াকে ঠেলে দেওয়া হলো অন্ধকার কারাগারে। জনগণের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হলো দিনের আলোয় এবং আগের রাতে।যা কিনা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে দিনের ভোট রাতে করার গল্প হিসাবে। অথচ সেই হাস্যকর নির্বাচনে বিজয়ী হাসিনাকে ভারত এক নিমিষে অভিনন্দন জানিয়ে দিল। মানুষের মনে তখন একটাই প্রশ্ন জাগল—যে দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে রক্ত-ঘামে পাশে ছিল, আজ কি সেই দেশই গণতন্ত্র হত্যার পৃষ্ঠপোষক?
শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে যে বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও নদীপথের চুক্তি করেছিল, সেগুলো জনগণের চোখে উন্নতি নয়, আত্মসমর্পণের দলিল। আর যখন ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে কণ্ঠরোধ শুরু হলো, তখন ভারতীয় নীরবতা আরও শীতল ও ভীতিকর হয়ে উঠল। সাংবাদিক, ছাত্র, লেখক, অনলাইন এক্টিভিস্ট—যে কেউ প্রতিবাদ করলে তার ঠিকানা কারাগার। জাতিসংঘ চিৎকার করে বলল এটি নিছক মতপ্রকাশ দমনের হাতিয়ার। অথচ দিল্লি নিশ্চুপ! সেই নীরবতা যেন ঢাকায় চলমান নিপীড়নের সহায়ক হয়ে দাঁড়াল।
সবচেয়ে করুণ চিত্র ছিল দিল্লিতে হাসিনার অভ্যর্থনা। তাকে স্বাগত জানালেন অজিত ডোভাল—ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা, যিনি গোটা অঞ্চলের গোপন খেলায় পরিচিত নাম। বাংলাদেশের মানুষের চোখে এটি ছিল আরেকটি আঘাত। হাসিনা যেন আর বাংলাদেশের নেত্রী নন, বরং ভারতের গোয়েন্দা যন্ত্রের প্রতিনিধি।
আজ রাস্তায় মানুষের কণ্ঠ গর্জে উঠছে। তারা আর কোনো অজুহাত মানছে না। তারা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরাতে চায়—বন্দি রাজনীতিবিদদের জন্য, ভুয়া নির্বাচনের জন্য, রক্তাক্ত রাস্তাঘাটের জন্য, সংবাদপত্রের কালো অধ্যায়ের জন্য। তারা চায় তিনি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ান, বিদেশি পতাকার ছায়ায় নয়, বাংলাদেশের মাটিতেই জবাব দিন।
দিল্লিতে শেখ হাসিনার এই আশ্রয়দানকে কেন্দ্র করে ফুসে উঠেছে ভারতের অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা। তাদের একজন ভারতের অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) প্রধান ও হায়দ্রাবাদের সংসদ সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি । তিনি বলেছেন, সরকার যদি সত্যিই ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ ভারত থেকে ফেরত পাঠাতে চায়, তবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠিয়ে সেটি শুরু করা উচিত।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর ‘আইডিয়া এক্সচেঞ্জ’ অনুষ্ঠানে ওয়াইসি বলেন, ‘ওই ক্ষমতাচ্যুত নেত্রীকে (হাসিনা) আমরা দেশে কেন রেখেছি? তাকে ফেরত পাঠানো হোক। উনি কি বাংলাদেশি নন?’
জনগণের ক্ষোভ আসলে এক দাহ্য আগুন—এটি শুধু রাজনীতির প্রশ্ন নয়,আত্মমর্যাদার লড়াই। তারা বলে দিচ্ছে: আমরা চাই না সীমান্ত পেরোনো কোনো পলায়নপর নেত্রী। আমরা চাই জবাবদিহি, চাই ন্যায়বিচার, চাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। আর এ লড়াই থামবে না যতক্ষণ না সেই দিন আসে, যেদিন নেত্রী নয়, জনগণ হবে প্রকৃত ক্ষমতার মালিক।