মন্জুরুল ইসলাম।
একই দিনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেন প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একটি হলো সব রাজনৈতিক দলের নেতাকে একমঞ্চে নিয়ে ঘোষণা করলেন জুলাই ঘোষণাপত্র। অন্যটি হলো রমজানের আগে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন করার সুদৃঢ় প্রত্যয়।
জাতিকে একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়াকে তিনি তাঁর শেষ কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। জাতির মুক্তির দিন ৫ আগস্ট দুটি ঘোষণা দেশব্যাপী প্রশান্তির পরিবেশ তৈরি করেছে। একটি নির্বাচিত সরকার ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করবে, অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কারের কাজগুলো সে সরকার বাস্তবায়ন করবে এমন প্রত্যাশা সবার। দেশবাসীর এ প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিকতার অভাব কখনোই ছিল না।
তবে অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা ধোঁয়াশা ছিল। কারণ দেশবাসীর কাছে মনে হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা যা চাচ্ছেন, তাঁর সহকর্মীরা হয়তো তা চাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে বিপ্লবীদের চাপ তো আছেই। তারপরও সব দিক সামলে ফেব্রুয়ারিতে যদি একটি স্মরণীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়, তাহলে ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশ প্রধান উপদেষ্টাকে মনে রাখবে। শেষটা ভালো করতে পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের সুনাম বাড়বে। সেই সঙ্গে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাও উজ্জ্বল হবে। এ ভালো কাজটি সম্পন্ন করার জন্য শুধু সরকার নয়, সবাইকেই সজাগ থাকতে হবে। কোনো অজুহাত বা ষড়যন্ত্র যেন গণতন্ত্রের যাত্রা রুদ্ধ করতে না পারে।
৫ আগস্ট, ২১ শ্রাবণ। শ্রাবণের স্বভাবসুলভ আচরণে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর বিশাল চত্বর ছিল বৃষ্টিস্নাত। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রধান উপদেষ্টার জন্য সকাল থেকেই অপেক্ষায় ছিল। অনেকে আশঙ্কা করছিলেন এমন বর্ষায় তিনি হয়তো ভার্চুয়ালি সমাবেশে অংশ নিয়ে বক্তব্য দেবেন। কিন্তু না, তিনি এলেন। সেই সঙ্গে মঞ্চে সঙ্গী করলেন রাজনৈতিক দলের নেতাদের। রাজনৈতিক নেতাদের এমন মিলনমেলায় তিনি সবাইকে অভিনন্দন জানালেন। সবিস্তার পাঠ করলেন জুলাই ঘোষণাপত্র।
তিনি যখন ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন তখন সব রাজনৈতিক নেতা তাঁর প্রতি বিনয় প্রদর্শন করলেন। পেশাগত জীবনে প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষক। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর মঞ্চে তিনি শিক্ষকসুলভ আচরণই করেছেন। পাশে যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁদের মনে হয়েছে তাঁর প্রিয় ছাত্রদের মতো। এমন পরিবেশে তিনি যা ঘোষণা করলেন, তা নিয়ে অনেকেরই আলাদা মতামত থাকতে পারে। কিন্তু উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ’২৪-এর বিপ্লবের যে বর্ণনা তিনি দিলেন, তা সত্যিই অপূর্ব।
তিনি তাঁর ঘোষণাপত্রে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা, ’৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন, বাকশাল কায়েম, ’৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব, ’৯০ সালের গণ অভ্যুত্থান, ’৯১ সালে পুনরায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন, ১/১১-এর ষড়যন্ত্র, ২০১৪, ’১৮ ও ’২৪-এর প্রহসনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ ইতিহাস স্পর্শ করেছেন। তবে জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে বাকশাল করার পরিণতি বা ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট মুজিব শাসনাবসানের অংশটুকু যুক্ত করা হলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেত।
ঘোষণাপত্রের ২৮টি ধারাতেই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২৪ থেকে ২৮ পর্যন্ত ধারাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সব শহীদকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে প্রয়োজনীয় সব আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ যুক্তিসংগত সময়ে আয়োজিতব্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে যে একটি পরিবেশ ও জলবায়ুসহিষ্ণু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নকৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষিত হবে। ২৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে এবং ২৮ ধারায় বলা হয়েেেছ, ৫ আগস্ট ২০২৪
সালে গণ অভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো।
কয়েকটি রাজনৈতিক দল অবশ্য তাঁর এ ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছে। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হয়েছে বিপ্লবীদের পাঁচজনের কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়ার বিষয়টি। ৫ তারিখ ছিল বিপ্লবীদের জন্য আনন্দের দিন। সে আনন্দ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে প্রকাশ না করে তাঁরা বেড়াতে চলে গেলেন কক্সবাজারে। এটা তাঁদের বেড়ানো, নাকি অভিভাবক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অভিমান, নাকি জুলাই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান- তা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হলো না।
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে তাঁর সরকারের তিনটি দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি হলো সংস্কার, একটি বিচার এবং সর্বশেষ দায়িত্ব হলো নির্বাচন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে এসেছে। জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক অর্জন। এটা শুধু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নয়, বৃহত্তর পরিমণ্ডলের রাজনৈতিক ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জুলাই সনদ বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা, নাগরিক অধিকারের সত্যিকারের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সামর্থ্যরে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ফ্যাসিবাদ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা অত্যন্ত দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন। এ বিষয়ে তিনি তাঁর বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা রাখেননি। তিনি বলেছেন, জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে। বিচারের আনুষ্ঠানিক শুনানিপর্বও শুরু হয়েছে। ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে যারা জড়িত, তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনকে সরকারের সর্বশেষ দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাব, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের
ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আপনারা সকলেই দোয়া করবেন যেন সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এ দেশের সকল নাগরিক একটি “নতুন বাংলাদেশ” গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখরভাবে সম্পন্ন করা যায় সেজন্য সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করব।
এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তিশৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে সেজন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করতে আগামীকাল থেকে আমরা সকলেই মানসিক প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরু করব।’ তিনি আরও বলেছেন, দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যতগুলো বড় সংঘাত, সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোর নেপথ্য কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো দল যদি গায়ের জোরে ক্ষমতায় আসে তার চূড়ান্ত পরিণতি কী তা জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে দেশবাসী বুঝতে পারলাম যে আমরা এখন নির্বাচনি টানেলে ঢুকে পড়েছি। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। এখন আমরা শুনতে পাব হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা। নির্বাচন কমিশনকে শুধু তফসিল ঘোষণা করলেই হবে না, তাদের পূর্বসূরি হাবিবুল আউয়াল, নূরুল হুদার পরিণতিও মনে রাখতে হবে। কোনো প্রলোভন নয়, কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় নয়, সততার সঙ্গে যদি নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করে তাহলে প্রধান উপদেষ্টার স্বপ্ন পূরণ হবে।
আগামীকাল সরকারের এক বছর পূর্ণ হবে। এ সময়ের মধ্যে সরকারের কাছে অনেকের অনেক প্রত্যাশা ছিল। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতি গতিশীল রাখা, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা, মব ফ্যাসিজম বন্ধ করা, জনমনের ভয় দূর করার মতো অনেক প্রয়োজনীয় কাজ সরকার হয়তো যথাযথভাবে করতে পারেনি। কিন্তু সময় শেষ হয়ে গেছে এমনও নয়। সামনে আরও ছয় মাস আছে।
এ সময়ের মধ্যে সরকারকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। সবাইকে নিয়ে নির্বাচন যেমন করতে হবে, তেমন নির্বাচন যেন কেউ ভন্ডুলের ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী মাসে ডাকসু, রাকসু ও চাকসু নির্বাচন। এ মুহূর্তে এই তিনটি নির্বাচনই স্পর্শকাতর। অনেকেই মনে করছেন তিনটি নির্র্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো প্রকার চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র শুরু হলে তা জাতীয় নির্বাচনের পথচলা বিঘ্নিত করতে পারে। সে কারণে এখন থেকেই সবাইকে সাবধান হতে হবে।
শেষ কাজটি প্রধান উপদেষ্টা সুন্দরভাবে করতে পারবেন- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। কারণ শেষ ভালো যার সব ভালো তার।