Sunday, June 1, 2025
More
    Homeঅর্থনীতিরাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তায়’ অর্থনীতির কী হাল?

    রাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তায়’ অর্থনীতির কী হাল?

    আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে এবং রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’ কতটা কাটবে, তার ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি।

    নানামুখী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থান ও পরবর্তী রাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তার’ কারণে অর্থবছরের শেষে এসেও অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তার মেঘ কাটেনি।

    আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে এবং রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’ কতটা কাটবে, তার ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি।

    চলতি অর্থবছরে রপ্তানি ও রেমিটেন্স আশা দেখালেও মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ খরা ও বেকারত্ব বৃদ্ধি, বিদেশি ঋণে ভাটা, এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি, ব্যাংক খাতের দুর্দশা, রাজস্ব আহরণে হতাশা আগামী অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

    ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে রাস্তায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও শাহবাগ এলাকায় অবরোধ-অবস্থান চলে টানা কয়েক দিন। ফাইল ছবিক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে রাস্তায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও শাহবাগ এলাকায় অবরোধ-অবস্থান চলে টানা কয়েক দিন। ফাইল ছবি

    রাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তা’ ও আন্দোলনের ডামাডোলে প্রশাসনে যে ‘স্থবিরতা’ দেখা দিয়েছে, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার সঙ্গে এ অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকলে অর্থনীতির ‘হাঁটু ভেঙে’ পড়ার শঙ্কা দেখছেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ।

    বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এত নানা প্রকারের আন্দোলন প্রতিদিনই রাজপথে, এত মানুষের দুর্ভোগ, এগুলো তো অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। আন্দোলনের যতই যৌক্তিকতা থাকুক, আমরা তো দেখছি যৌক্তিক-অযৌক্তিক সব ক্ষেত্রেই মানুষ রাজপথে নেমে পড়ছে।

    “তিন-চার ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এভাবে অর্থনীতির হাঁটুটা ভেঙে যায়, দুর্বল হয়ে যায়।”

    দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেটের সময়ই অর্থনীতিতে সংকট চলছিল। মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতিকেও সংকটে ফেলে দিয়েছিল।

    অর্থবছরের শুরুতে জুলাই মাসে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের আন্দোলন ও তার ধারাবাহিকতায় প্রবল আন্দোলন অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে। গতবছর ৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করে। রপ্তানিও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

    তবে অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোতে উন্নতির গতি ধীর হয়ে গেছে, নয়ত নেতিবাচক ধারায় রয়ে গেছে, যার প্রতিফলন দেখা গেছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে।

    গত ১০ মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দাবিতে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলেছে। জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়ে রাজনীতিতে নতুন করে ‘অস্থিরতা’ তৈরি হয়েছে।

    এছাড়া সচিবালয়ে রদবদল ঘিরে বিক্ষোভ, সরকার চাকরি আইন সংশোধন নিয়ে বিক্ষোভ-কর্মবিরতি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি বিভাগ করার অধ্যাদেশ ঘিরে টানা কর্মবিরতিও অর্থনীতির জন্য অস্বস্তি হয়ে আসে। এ অবস্থায় ২ জুন অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে।

    ইতিবাচক ধারায় রেমিটেন্স

    রেমিটেন্সের ‘উল্লম্ফন’ ও রপ্তানিতে মাঝারি ধরনের প্রবৃদ্ধির কল্যাণে বহিঃখাতের ভারসাম্য অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে, যা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

    আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখা, বিদেশি দায়-দেনা মেটানো ও দেশে আসা বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও সহায়তার সঙ্গে রেমিটেন্স যুক্ত হয়ে এখন রিজার্ভ যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে বড় ধরনের ঝুঁকি না থাকার কথাই অর্থনীতিবিদরা বলছেন।

    রিজার্ভ নিয়ে এমন আশার মূল কারণ রেকর্ড পরিমাণে রেমিট্যান্স আসা; জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা ‘একাত্মতা’ পোষণ করে যে রেমিটেন্স আটকে দিয়েছিল, অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তা একত্রে দেশে আসায় একক মাস হিসেবে ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্সও এসেছে। এর ফলে গত কয়েক মাসে ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরেই থাকছে রিজার্ভ।

    কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১৩ দিনেই এক বিলিয়ন ডলার যোগ হওয়ায় ৩০ এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভ ১৯ মাস পর ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়; সে সময় রিজার্ভ দাঁড়িয়েছিল ২২ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার।

    হালনাগাদ তথ্য বলছে, দায়-দেনা পরিশোধের ফলে রিজার্ভ আবার কমলেও এখনও তা ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরেই আছে। ২৪ মের তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ রয়েছে সাড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারের মত, যা আগের অর্থবছরের ওই দিনে ছিল সাড়ে ১৮ বিলিয়নের খানিকটা বেশি।

    অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রেমিটেন্সে বাড়ার যে ধারা দেখা যায়, সে ধারায় সবশেষ দুই মাসেই ৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর প্রবাসী আয় আসে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে এ দুই মাসেই।

    মাস মার্চে রোজার ঈদকে ঘিরে প্রবাসীরা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছিলেন, যা একক মাসের হিসাবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

    বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ ছাড়া দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, ২৬৪ কোটি ডলার।

    এপ্রিলে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছে, যা আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি।

    ব্যাংকিং চ্যানেলে এপ্রিলে প্রবাসীদের পৌনে ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠানোর তথ্য রোববার দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান।

    আগের বছর একই মাসে রেমিটেন্স এসেছিল ২ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেমিটেন্স বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।

    এর ফলে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাড়ে ১০ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় ২৫ বিলিয়ন বা আড়াই হাজার কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

    বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এর আগে দেশে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। সেবার প্রবাসীরা পাঠান ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার।

    তবে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়ে প্রবাসীদের আটকানো রেমিটেন্স এখন পাঠানোর পাশাপাশি ‘পাচার ঠেকানো’ গেছে বলে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে।

    রপ্তানিতে আশা-নিরাশা

    বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তৈরি পোশাক খাত শ্রমিক আন্দোলন, নৈরাজ্য, কারখানা বন্ধের মত বড় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে।

    এর ফলে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হলেও দেখা যায়, মাঝারি ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্থবছরের বেশিরভাগ সময় ধরেই ছিল। মনে করা হচ্ছিল, পোশাক খাতে সস্তা শ্রমের সঙ্গে গুণগত মান ধরে রাখার ফলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তাতে খুব সহজে ভাটা পড়বে না।

    তবে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতির প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবেই পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে; এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন, ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, স্থল বাণিজ্যে বিধিনিষেধের ফলে রপ্তানিতে সে ধারা বদলে গিয়ে হতাশা তৈরি করেছে।

    রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১০ মাসের মধ্যে এপ্রিলে সর্বনিম্ন রপ্তানি আয় দেখেছে দেশ। এ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩০১ কোটি ৬৬ লাখ ডলার।

    এক মাসের ব্যবধানে রপ্তানি আয় কমে প্রায় ১২৪ কোটি ডলার। গত মার্চ মাসে রপ্তানি আয় হয় ৪২৫ কোটি ডলার।

    চলতি অর্থবছরে এর আগে সর্বনিম্ন রপ্তানি আয় ছিল গত সেপ্টেম্বরে। সে মাসে এ খাত থেকে আয় ৩৫২ কোটি ডলার।

    এপ্রিলে পোশাক খাতে আয় ‘সামান্য’ বেড়েছে। সে মাসে রপ্তানি আয় হয় ২৩৯ কোটি ডলার, মার্চে যা ছিল ২৩৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়েছে।

    পোশাক খাতের ওপর ভর করেই সামগ্রিক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি দেখে দেশ। এপ্রিলে এ খাতে বৃদ্ধির হার দশমিকের ঘরে থাকায় সামগ্রিক রপ্তানিতেও বৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ৮৬ শতাংশ।

    চলতি অর্থবছরের অক্টোবরেও রপ্তানি খাত ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখেছে। এমনকি আন্দোলনের মাস জুলাইয়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও অগাস্টে ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।

    যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক স্থগিতের পর এ নিয়ে দেশটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে আলোচনার খবর এসেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি শুল্ক কমানোর আলোচনাও রয়েছে।

    এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার জন্য কেবল দেশটি থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক না কমিয়ে দেশের শুল্কহার সংস্কারের পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

    তার মতে, “শুধু আমেরিকাকে লক্ষ্য করে না, সার্বিকভাবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর শুল্ক হার আমাদের কমাতে হবে।

    “সেটা এখন থেকেই শুরু হোক এবং এক ঢিলে দুই পাখি তখন আপনি মারতে পারবেন।”

    ভারতের ওপর পাল্টা বাণিজ্য বিধিনিষেধ না দিয়ে বা ‘যুদ্ধ’ না করে দেশটির সঙ্গে সরকারিভাবে আলোচনার পরামর্শ দেন ২০০৭-০৮ মেয়াদে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।

    এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পাল্টা ব্যবস্থা নিলে খরচ বেড়ে যাবে বলে সতর্ক করেছেন তিনি। বলেন, “ভারত থেকে পণ্য আমদানি না করলে তো সমস্যা হবে। কেননা, যদি বিকল্প উৎস, যদি আমরা চীন থেকে আনতে চাই বা অন্য জায়গা থেকে আনতে চাই, তাতে তো খরচের মাত্রা আরো বাড়বে।”

    ভারত যাতে বাণিজ্য বাধা তুলে নেয় সেজন্য দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

    মূল্যস্ফীতি আশা দেখাচ্ছে?

    ২৬ মাস পর এপ্রিলে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি দেখেছে বাংলাদেশ। সে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ যা সবশেষ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির পর সবচেয়ে কম।

    বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, এপ্রিল মাসে শহর ও গ্রামীণ পর্যায়ে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় খাতেই ‘খরচ কমেছে’। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি অনেকটা কমার তথ্য দিয়েছিল সরকার, তবে তখন কেবল খাদ্য খাতেই কমেছিল মূল্যস্ফীতি।

    এ তথ্য আশা দেখালেও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি কমার ধারা কতদিন থাকবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে, কারণ এর আগে ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও পরের মাসেই তা বেড়ে যায়।

    দেশে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা চলছে, তাতে দরিদ্র মানুষের জীবনমান তলানিতে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন মির্জ্জা আজিজ। মূল্যস্ফীতির কারণে যে ব্যাংক খাতকেও ভুগতে হয়, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।

    সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “অর্থনীতির বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। সম্প্রতি সামান্য একটু কমেছে, কিন্তু এখনো ৯ শতাংশের উপরে আছে মূল্যস্ফীতি। এখন মূল্যস্ফীতি বেশি হলে আপনার অনেকগুলো সমস্যা সৃষ্টি হয়; একটা হচ্ছে যে লোকে ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হয় না।

    “কেননা ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে যে সুদ পাবে সঞ্চয়কারীরা, মূল্যস্ফীতি তো তার বেশি। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকে টাকা রাখলে আপনি আপনার মূলধন হারাচ্ছেন। কাজেই ব্যাংকিং খাতে সমস্যা সৃষ্টি হবে।”

    বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অবশ্য বলছেন, চলতি বছরের শেষের দিকে দেশে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে।

    সম্প্রতি তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অগাস্টের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে, জুনে ৮ শতাংশে। আর এ বছর শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে।

    মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে যেভাবে সংকোচনমূলক নীতি নেওয়া হয়েছে তা খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না তুলে ধরে জাহিদ হোসেন বলেন, “মূল্যস্ফীতি এখনও যে পর্যায়ে আছে তা খুবই অসহনীয়। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের জন্য এটা মোকাবেলা করা খুবই কঠিন। কাজেই যেটুকু কমেছে সেইটা দিয়ে তুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা আগামীতে এটা ধারাবাহিকভাবে যে কমতে থাকবে সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

    চাঁদাবাজি ও হাতবদলের কারণে যে মূল্যস্তর বেড়ে যায় তা নিরসনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “এটি কমানো গেলে এভাবে দীর্ঘদিন সুদের হার বাড়িয়ে রাখতে হত না।”

    মূল্যস্তর বেড়ে যাওয়ার পেছনে উৎপাদন খরচের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বিতরণ খরচকেই কারণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। বলেন, “উৎপাদন খরচের চেয়ে যদি বিতরণের খরচটা অনেক বেশি হয়ে যায় তাহলে তো স্পষ্ট যে এখানে মানে, অনেক ধরনের হাতবদল হচ্ছে পণ্যটা। ওই হাতবদল প্রতিটা পর্যায়েই, যার হাত দিয়ে বের হচ্ছে সেতো কিছু মুনাফা সেখানে পাচ্ছে এবং সেটা মূল্যের সাথে যোগ হচ্ছে।

    “যদি চাঁদাবাজি যোগ করেন এবং চাঁদাবাজিটা প্রত্যেকটা পর্যায়ে, তাহলে পণ্যের মূল্যের স্তরটা তো অনেক উঠে (বেড়ে) যায়।”

    রাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তা’ বিনিয়োগে বাধা

    সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর তথ্য মেলে দ্বিতীয় প্রান্তিক অক্টোবর-ডিসেম্বরেই।

    এ প্রান্তিকে বিদেশি বিনিয়োগের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮২৯ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে স্থিতি ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে স্থিতি বেড়েছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

    বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৪৯ কোটি ৪ লাখ ডলার নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে; যা আগের কয়েক অর্থবছরের হিসেবে অর্ধেকরও কম।

    কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৪১ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৬০ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭১ কোটি ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩২ কোটি ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২০ কোটি ডলার নিট বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ।

    চলতি অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৪ শতাংশের নিচে নামার যে তথ্য বিবিএস দিয়েছে তাতে দেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতির দুর্দশার প্রতিফলন ঘটছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারাও বলছে দেশি বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে।

    বিবিএস বলছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা কোভিডের সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি বাদ দিলে গত দুই দশকের মধ্যে এত কম প্রবৃদ্ধি আর কোনো বছরে দেখেনি বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ।

    বেসরকারি ঋণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জুলাই আন্দোলনের পর প্রবৃদ্ধির যে নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়েছিল তা ওঠানামা করলেও সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি পরবর্তী নয় মাসেও।

    মার্চে ঋণ প্রবৃদ্ধি সামান্য বেড়ে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশে উঠে যা আগের মাসেও ছিল ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ; এর মধ্য দিয়ে টানা পাঁচ মাস ধরেই ৮ শতাংশের নিচে রয়ে গেছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি।

    এর আগে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধির তথ্য মেলে ২০২১ সালের মে মাসে। কোভিড মহামারীর মধ্যে সে সময় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমেছিল।

    উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগ খরার সঙ্গে বেকারত্বও বাড়ছে। বিবিএসের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বেকার মানুষের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৬০ হাজার। একবছর আগে যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে দেশে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। সংস্থার ত্রৈমাসিক জরিপে পরের তিন মাস, অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্ব বেড়ে ২৭ লাখ ৩ হাজারে দাঁড়িয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

    নির্বাচন নিয়ে ‘অনিশ্চয়তা’ ও সেটি ঘিরে রাজনীতিতে যে ‘অস্থিরতা’ চলছে, এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ আসে না বলেই মত অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ও মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের।

    মির্জ্জা আজিজ তার মূল্যায়ন তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো ‘বিভিন্ন মত’ প্রকাশ করতে থাকায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ‘অনিশ্চিত’ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

    তার ভাষ্য, “এই অনিশ্চিত পরিবেশে তো বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ে না। তো কাজেই, আমাদেরকে চেষ্টা করতে লাগবে যে এই অনিশ্চয়তাটা কীভাবে দূর করা যায়।”

    নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তায়’ দেশে এখন বিনিয়োগের ‘পরিবেশ নেই’ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তার মতে, এরকম অবস্থায় ব্যবসায়ীরা ‘টাকা পকেটে রাখাই পছন্দ করেন’।

    বিদেশি ঋণে ভাটা, পরিশোধে চাপ

    নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভাবা হচ্ছিল, তা যে ভাবমূর্তি তাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এ খাতে বেসরকারি নিয়োগ দিতেও দেখা গেছে। এর সঙ্গে বিদেশি ঋণ ও সহায়তা বাড়ার সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছিল।

    কিন্তু অর্থবছরের নয় মাস শেষেও বিনিয়োগ বাড়ার তথ্য নেই, বিদেশি ঋণের অর্থ ছাড়েও নেতিবাচক ধারা চলছে। ঋণের প্রতিশ্রুতিও মিলেছে নগণ্য। তবে এ সময় ঋণ পরিশোধ বেড়েছে সর্বোচ্চ।

    চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে বিদেশি অর্থায়ন মিলেছে ৪৮০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ ও অনুদান কমেছে ১৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।

    পাশাপাশি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতিতে ভাটা দেখা গেছে। এ সময়ে প্রতিশ্রুতি মিলেছে ৩০০ কোটি ৫২ লাখ ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২৪ কোটি ২১ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে সাড়ে ৫৮ শতাংশ।

    এ সময়ে সরকারের বিদেশি ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমলেও আগের ঋণ পরিশোধ প্রায় সাড়ে ২১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১২ কোটি ২০ লাখ ডলারে। স্থানীয় মুদ্রায় তা ৩৮ হাজার ৬৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

    পরিশোধিত অর্থের মধ্যে ছিল আসল ২০১ কোটি ১০ লাখ ডলার ও সুদ ১২০ কোটি ১০ লাখ ডলার।

    হালনাগাদ তথ্য বলছে, আগের অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার; যা স্থানীয় মুদ্রায় ২৮ হাজার ২৮১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

    এডিপি বাস্তবায়ন দেড় দশকে সর্বনিম্ন

    অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরার পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া প্রকল্প যাচাই-বাছাই শুরু করে। অনেক প্রকল্প ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ নেওয়া হয়েছে বলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

    এর সঙ্গে বিগত সরকারের প্রশাসন ভেঙে পড়ায় অনেক আমলা, যারা প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তাদের পাওয়া যায়নি বলেও অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে বলা হয়। একই রকম তথ্য মেলে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি কোম্পানির ক্ষেত্রেও। এ অবস্থায় অর্থবছরের ১০ মাস ধরেই এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি চলছিল।

    এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সংশোধিত এডিপির ব্যয় হয়েছে ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ; গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ হার ছিল ৪৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।

    পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য বলছে, জুলাই থেকে এপ্রিল সময়ে বাস্তবায়নের এ হার গত দেড় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের তথ্য খোলা মাধ্যমে রাখেনি সরকার; সেই তথ্য মিললে বাস্তবায়নের এ হার আরও বেশি সময়ের মধ্যে কম হওয়ার শঙ্কা থাকছে।

    বাস্তবায়ন কম হওয়া প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “আমি আগেও অনেকবার বলেছি যে এইটার (চলতি অর্থবছর) মূল বাজেট বরাদ্দ যা ছিল আসলে তার বাস্তবায়ন অনেক কম হবে। অন্য বছরের তুলনায় কম হবে। কেন কম হবে তার কারণও আমরা বলেছি, যেই প্রকল্পগুলো আছে এগুলোকে তো আমরা প্রত্যেকটাই যাচাইবাছাই করে দিচ্ছি। কাটছাঁট করছি। ছোট করছি।

    “এছাড়া ঠিকাদাররা চলে গেছে। প্রকল্প পরিচালকরা চলে গেছে। এগুলোকে আবার চলমান করতে সময় লেগেছে। সেইভাবে বাস্তবায়ন কমেছে এবং যে প্রকল্পগুলোতে অনেক অপচয় ছিল, সবগুলো যখন আমরা সংশোধন করেছি তখন সেগুলোর ব্যয় সংকোচন হয়েছে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের গতি ধীর হয়ে গেছে।”

    সংশোধিত এডিপিতে টাকার অঙ্কে কমানো হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

    চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকার এডিপি কমিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা করেছে।

    বরাদ্দ কাটছাঁট করলেও সময়মত বাস্তবায়ন ও সমাপ্য প্রকল্প আগে শেষ করার দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

    তিনি বলেন, “উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুশাসনের মাধ্যমে সাশ্রয়ীভাবে এগুলোকে সময়মত বাস্তবায়ন করতে হবে। সমাপ্য প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে আগে আগে। সেইটার দিকে নজর দেওয়া, অগ্রাধিকার দিতে হবে যেগুলো সমাপ্য এবং যেগুলো চলমান প্রকল্প আছে।”

    চলতি অর্থবছর ও আগামী অর্থবছরের জন্যও এডিপির ‘মানসম্মত’ বাস্তবায়ন সরকারের ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

    ব্যাংক খাতের কী দশা?

    বিগত সরকারের সময়ের অর্থ ছাপিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে খরচের ধারা অব্যাহত না রাখার পক্ষে অন্তর্বর্তী সরকার জোরালো অবস্থান তুলে ধরেছিল বারবার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

    ইউনূস সরকারও অর্থ ছাপিয়ে সরাসরি ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দিয়েছে, যদিও তা না করার কথাই বলা হয়েছিল।

    ব্যাংকিং খাতের দুর্দশা কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে আমলা নিয়োগের যে ধারা ছিল তা থেকে বেরিয়ে এসে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগ দেয় অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরকে।

    গভর্নরের দায়িত্ব পাওয়ার পর আহসান মনসুর আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোতে তারল্য সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেন; এরপর থেকেই ইসলামী ধারার এসব ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট তৈরি হয়। ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে, এমন গুজবেও এ ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে নেওয়ার তথ্য মেলে।

    তারল্য সংকট কাটাতে ২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়টি ব্যাংককে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেয়।

    তখন আহসান মনসুর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

    এরপর আরও একাধিকবার টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেওয়ার ঘটনা ঘটে; তবে গভর্নর সে সময় যুক্তি দেখিয়েছিলেন, এ অর্থের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের’ মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। ফলে অর্থ ছাপানোর কারণে যে মূল্যস্ফীতি বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়, তা এর মধ্য দিয়ে ঘটবে না।

    তবে এ তারল্য সহায়তা দেওয়ার ঘটনাই বলে দেয়, এ খাতে এখনও শঙ্কা কাটেনি।

    এর মধ্যেই ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা বলেছেন গভর্নর। চলতি বছর জুলাইয়ের মধ্যে এ প্রক্রিয়া শেষে একীভূত ব্যাংকটির জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারী খোঁজা হবে বলে সোমবার চ্যানেল ২৪ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

    ব্যাংক থেকে লুট হওয়া পাচারের অর্থ ফেরানোর ক্ষেত্রেও এখন পর্যন্ত সাফল্য নেই সরকারের। বারবার গভর্নর ও সরকারের তরফে তাদের অবস্থানের স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য মিললেও কাগজে-কলমে সাফল্য মেলার তথ্য নেই।

    সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দুটি বাজেট দেওয়া মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “এটা খুব কঠিন ব্যাপার। আমরা যতই বলি না কেন উচ্চস্বরে যে ফেরত আনা হবে; কিন্তু আমি মনে করি এটা সহজসাধ্য ব্যাপার না।

    “এটা খুব কঠিন। তার কারণ হচ্ছে ধরুন যে, কেউ যদি সেখান থেকে টাকা লুট করে বিদেশের কোনো ব্যাংকে পাঠায়, সেখানে তো তালা দিয়ে কোনো সিন্দুকের মধ্যে রাখছে না। তারা কোনো ব্যাংকে জমা দিচ্ছে। যেমন সিঙ্গাপুরে হোক বা হংকং হোক বা অন্য দেশে হোক। এখন সেখান থেকে টাকা আনতে গেলে আপনাকে ওই দেশের আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া লাগবে। সেখানে আদালতের আদেশ না পেলে তো কেউ টাকা ফেরত দেবে না এবং এটা বেশ কঠিন।”

    আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আমলে নিলে পাচারের ১০০ টাকায় ফেরত আসার পরিমাণ ১ টাকা, বলেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ।

    তার ভাষ্য, “এটা ফেরত আনা খুবই কঠিন। আপনি আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা যদি দেখেন, আন্তর্জাতিক ধারণা হচ্ছে প্রতিবছর পাচার হওয়া অর্থের প্রবাহ প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের মত বিভিন্ন দেশ থেকে চলে যায় বা ভেতরে চলে আসে।

    “পুনরুদ্ধারের হারটা হচ্ছে, আপনার ১০০ টাকা যেখানে অবৈধভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে ফেরত আসার পরিমাণ হচ্ছে এক টাকা। কাজেই এইটা নিয়ে, যেটা গেছে, সেইটা আপনি ফেরত আনতে পারবেন-এটা অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং সেই প্রক্রিয়া শেষেও যে ফল পাবেন, এটার কোনো নিশ্চয়তা নাই।”

    এমন পরিপ্রেক্ষিতে সামনে আর যাতে অর্থ পাচার না ঘটে বা বন্ধ করাই হবে সরকারের প্রথম কাজ, যোগ করেন তিনি।

    রাজস্ব আদায় যখন গলার কাঁটা

    জুলাই-অগাস্টের অস্থিরতা আর রাজনৈতিক ডামাডোলে সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয়েছে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির ধারায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়েও বিনিয়োগ অস্থিরতা ও অর্থনীতির মন্দার মধ্যে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

    অর্থবছরের এখনও তিন মাসের রাজস্ব আহরণের তথ্য বাকি থাকায়, এক লাখ কোটির মত ঘাটতি হয়ে যেতে পারে বলেই শঙ্কা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর কর্মকর্তাদের।

    অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করছেন, চলতি অর্থবছরের ‘পরিস্থিতি বিবেচনায়’ ৪ লাখ কোটি টাকা আদায় করতে পারলেই সেটি ‘উল্লেখযোগ্য অর্জন’ হবে।

    সরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে প্রথমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি করে, যা আগে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত লক্ষ্য পূরণে এনবিআর প্রতিমাসের জন্য আলাদা লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এতে দেখা গেছে, জুলাই-মার্চ শেষে লক্ষ্যের চেয়ে রাজস্ব আদায় পিছিয়ে আছে ৬৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

    এর বাইরে আইএমএফ বলেছে, চলতি অর্থবছরে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা; সে হিসাবে শেষ তিন মাসে আহরণ করতে হবে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা, প্রতি মাসে ৬৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রথম নয় মাসের হিসাবে প্রতি মাসে গড় আদায় ছিল সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।

    রাজস্ব আদায় বাড়াতে ‘কর ফাঁকি’ ধরার পরামর্শ বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের।

    অর্থবছরের মাঝ পথে এসে হঠাৎ শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর ও ভ্যাট বাড়ালেও তেমন আদায় বাড়েনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে তাই কর বাড়ানোর এ সহজ পথে না গিয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান। যারা কর দেন তাদের হয়রানি না করে কর জাল বাড়াতেও ‘নজর’ দেওয়ার বিষয়ে জোর দিয়েছেন তিনি।

    তার ভাষ্য, “উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে স্বস্তি দিয়ে প্রত্যক্ষ কর কীভাবে বাড়ানো যায়, আয়কর বলি, আর কর্পোরেট ট্যাক্স বলি, এইটা বাড়াতে চেষ্টা করতে হবে। সেক্ষেত্রে যারা কর দিচ্ছে, কর জালে আছে, তাদের হয়রানি না করে কর ভিত্তিটা কীভাবে আরো বাড়ানো যায়, সেটা দেখতে হবে।”

    ‘অনলাইনে’ কর দেওয়া ও ‘ডিজিটালাইজেশনের’ মাধ্যমে কর জালকে ‘আরও প্রশস্ত করার দিকে নজর দেওয়ার’ পরামর্শ এ অর্থনীতিবিদের।

    সর্বশেষ

    জুলাই বিপ্লবে অপরাধের নিউক্লিয়াস ছিলেন হাসিনা: চিফ প্রসিকিউটর

    জুলাই বিপ্লবের সময় হত্যাযজ্ঞ চালাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা...

    পাটের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

    পাটের হারানো গৌরবের কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর...

    এবার ফ্যাসিস্ট রেজাউল করিম শোনালেন পালিয়ে যাওয়ার কল্প-কাহিনী

    ফ্যাসিস্ট হাসিনা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়ার পর তার...

    এবার ফ্যাসিস্ট রেজাউল করিম শোনালেন পালিয়ে যাওয়ার কল্প-কাহিনী

    ফ্যাসিস্ট হাসিনা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়ার পর তার...

    আরও সংবাদ

    জুলাই বিপ্লবে অপরাধের নিউক্লিয়াস ছিলেন হাসিনা: চিফ প্রসিকিউটর

    জুলাই বিপ্লবের সময় হত্যাযজ্ঞ চালাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা...

    পাটের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

    পাটের হারানো গৌরবের কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর...

    এবার ফ্যাসিস্ট রেজাউল করিম শোনালেন পালিয়ে যাওয়ার কল্প-কাহিনী

    ফ্যাসিস্ট হাসিনা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়ার পর তার...