আমিরুল ইসলাম কাগজী
মহাভারতে মহা শক্তিধর পঞ্চপান্ডবদের কথা আমরা জানি। কিন্তু তাদের যে আরেকটি ভাই ছিল সেটা অনেকে জানেন না। আবার পঞ্চপান্ডব এবং তাদের মা কুন্তী সেই পুত্রের কথা স্বীকার করত না। কারণ কুন্তীর বিয়ের আগেই সেই সন্তানের জন্ম হয়েছিল। কুন্তী যখন কুমারী ছিলেন তখন একদিন সূর্যদেবের সঙ্গে তাঁর মিলন হয়। যার ফলে তার গর্ভে আসে এক সন্তান। কিন্তু যেহেতু বিয়ের আগে এই সন্তানের জন্ম তাই তিনি সূর্য দেবের কাছে শর্ত দিলেনঃ তার কুমারীত্ব নষ্ট না করে সন্তান প্রসব করাতে হবে। সন্তান যেহেতু জন্ম নিয়েছে যেভাবেই হোক না কেন এখন তাকে ভূমিষ্ঠ করাতে হবে।
আবার কুমারিত্ব বজায় থাকতে হবে অর্থাৎ কুন্তী ভার্জিন থাকতে চান। অবশেষে সূর্যদেব কুন্তীর পীড়াপীড়িতে তার কান দিয়ে সন্তান প্রসব করালেন এবং নাম দিলেন কর্ণ। সেটা কোনো স্বাভাবিক ভুমিষ্ঠ প্রক্রিয়া ছিল না। অবৈধ সন্তানের জন্ম অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। শেখ হাসিনার সরকার ছিল অবৈধ। বিনা ভোটের সরকার। তার বিদায়ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হওয়ার কথা নয়। তাইতো ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মুখে তাকে দেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। তবে তিনি যে কতটা স্বার্থপর সেটা আবার বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। নেতাকর্মীদের ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার তোপের মুখে ফেলে রেখে নিজের জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
২.
শেখ হাসিনার বিদায় কোনো স্বাভাবিক পন্থায় হবে না সেটা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা মানুষ বিশ্বাস করত। তবে তার বিদায়ের টাইম ফ্রেমটা কারোর জানা ছিল না। সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন সরকার (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) ব্যবস্থা অনেকটা গায়ের জোরে তুলে দেওয়ার পর থেকে তার বিদায়ের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সকল রাজনৈতিক দল এবং মতের তোয়াক্কা না করে ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে এই অনিশ্চয়তা প্রকট হয়। নির্বাচন নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তখন তাকে সাহায্য করার জন্য দিল্লি থেকে পাঠানো হয় সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে। দিল্লির মসনদে তখন কংগ্রেস সরকার।।
ভারত তখন থেকেই শেখ হাসিনার সরকারকে রক্ষার জন্য ঢাল হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। এরপর ২০১৮ সালে আগের রাতে ভোট করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করা হলো। বিষয়টি নিয়ে অনেক ট্রল হয়েছে, তাতে অবশ্য শেখ হাসিনার কিছুই যায় আসে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছিলেন রাতের বেলায় নির্বাচন হতে পারে এটা তিনি কখনো জানতেন না। ২০২৪ সালের ৭জানুয়ারি নির্বাচন করলেন এক দলীয়ভাবে।
এই তিনটি নির্বাচন সফল করে তোলার জন্য শেখ হাসিনা পাশে পেয়েছেন জাতীয় পার্টির মতো একটি গৃহপালিত রাজনৈতিক দল এবং জনমত সৃষ্টির জন্য পেয়েছেন ধামাধরা একদল সাংবাদিক। সংখ্যায় তারা অনেক। ফলে দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানাতে মিডিয়া তাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছে। বলা যায় এই সংবাদকর্মীরাই শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ইন্ধন জুগিয়েছে। বিনিময়ে তারা বাগিয়ে নিয়েছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক আবাসিক এলাকায় প্লট এবং ফ্ল্যাট।
শেখ হাসিনা নিজেও তাদের দেখভাল করেছেন এবং তার পক্ষে রাখার জন্য এ ধরনের উপঢৌকন দিয়েছেন। কখনো কখনো দেশের বাইরে যাওয়ার সময় বিশাল লটবহর নিয়ে ভ্রমন করেছেন। সাংবাদিকরা এর প্রতিদান যথার্থই দিয়েছেন। মানুষের ভোটের অধিকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে এই সাংবাদিক গোষ্ঠীর চরম সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে। বিপরীতে যারা সত্য কথা লেখার চেষ্টা করেছেন তাদেরকে নানামুখী আইন দিয়ে দমন করে রাখা হয়েছে।
এরমধ্যে অন্যতম ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টএবং সাইবার সিকিউরিটি এ্যাক্ট । সরকার বিরোধী কোন সংবাদ প্রকাশিত হলেই কোনরকম ওয়ারেন্ট ছাড়াই তুলে আনা হয়েছে ওই সাংবাদিককে এবং দেওয়া হয়েছে জেল। ফলে সংবাদপত্র জগতে সৃষ্টি হয় এক বন্ধ্যাত্ব।
এসব কালাকানুনের কারণে সংবাদপত্রের স্বাভাবিক বিকাশ হুমকির মুখে পড়ে যায়। একশ্রেণীর সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক টিকে থাকেন কেবলমাত্র ফ্যাসিবাদী সরকারের মনোরঞ্জন করে। আর যারা বিরোধিতা করে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন তারা ছিলেন কঠিন যাতাকলে।
এখন প্রতিদিন পত্রিকা এবং টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যায় অনেক ঘটনার মামলা হচ্ছে। সেগুলোর বৈধ এবং চাক্ষুষ প্রমাণও আছে। যেমন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাশা বার্নিকাট ধানমন্ডিতে সুজনের চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদারের বাসভবনের সামনে যুবলীগ ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছিলেন।
দূতাবাসের পক্ষ থেকে সেই সময় মামলা করা হলেও সেটা তদন্তের পর্যায়ে থেকে যায়। সাগর রুনি হত্যা মামলা ১১৫ বার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় পড়লেও বিচারের জন্য সেটা আলোর মুখ দেখেনি। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ছিল তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়নি। তা সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে কখনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি কারণ তার পেছনে ছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ। বর্তমান অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর সেই মামলা র্যাবের হাত থেকে নিয়ে নিম্ন আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে। মামলার বিচার শুরু হবে এমন খবর পাওয়ার পর থেকে এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
এমনিভাবে বিভিন্ন সময় খবর প্রকাশ করার জন্য প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে সাভার থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং সাপ্তাহিক কাগজের সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে সীমান্ত পার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় একমাস পর চোখ বাঁধা অবস্থায় তাকে সীমান্ত থেকে উদ্ধার করা হয়। সবই ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাটক। বিরোধী দলমতকে দমিয়ে রাখতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। কখনো জঙ্গি নাটক সাজানো হয়েছে।
কখনো বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার নাটক সাজানো হয়েছে। সেসব সাজানো নাটকের অন্তরালের খবর বের করা মূলধারার পত্রিকা গুলোর পক্ষে সম্ভব হয়নি। মূল ধারার গণমাধ্যম সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় তখনো তাদের খবর সঠিকভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। মূলধারার গণমাধ্যমের বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল তখন সবচেয়ে সোচ্চার। কোটা সংস্কার নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা প্রাধান্য পেয়েছে মূলধারার গণমাধ্যমে।
হাইকোর্টে রিট করা থেকে শুরু করে আপিল বিভাগের শুনানি পর্যন্ত সবখানেই ছিল একতরফা প্রচারণা। শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি সঠিকভাবে গণমাধ্যমে আসেনি। এমনকি ১৬ জুলাই যখন প্রথম শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো হয় সেদিনও গণমাধ্যম ছিল নির্বিকার। কিন্তু বিকল্পধারার সংবাদ মাধ্যম যাকে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলে থাকি সেখানেই এক বিপ্লব ঘটে যায়। সারাদেশে শহীদদের তালিকা প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক। এমনকি রংপুরে প্রথম শহীদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের শাহাদাত বরণের ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এক ভিন্ন অপচেষ্টা চালানো হয়।
আন্দোলন সংগ্রাম যখন তুঙ্গে সে সময় সরকারের নির্দেশনা মান্য করে গণমাধ্যম একতরফা প্রচার চালিয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে যেটা ছিল বিরল ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দমন করার জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। সান্ধ্য আইন জারি করে জনগণকে ঘরের ভেতর আটকে রাখার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হলো। মূলধারার গণমাধ্যম সেখানে নিরব। দ্বিতীয় দফায় যখন সরকার জোট সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন দমন করার জন্য দেখামাত্র গুলির নির্দেশ প্রদান করলো তখনও মূলধারার সংবাদ মাধ্যম নীরব।
শুধু নীরব বললে ভুল হবে, কোনো কোনো গণমাধ্যম আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে। তারা নিরস্ত্র নিরীহ শিক্ষার্থীদের দুর্বৃত্ত বলে তীব্র আক্রমণের তীর নিক্ষেপ করে। এক্ষেত্রে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন সবচেয়ে এগিয়ে ছিল।
তাদের কয়েকজন আলোচক আন্দোলনকারীদের দুর্বৃত্ত বলে তাদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকালীর বাহিনীকে উৎসাহিত করেছে।১৯৫২ র’ ভাষা আন্দোলন,’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ‘৯০এর এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন – প্রতিটা ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের যে ভূমিকা ছিল বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সেই ভূমিকা চোখে পড়ে নাই।
অবশেষে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংগ্রামের পাশে পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিদেশী সংবাদ মাধ্যমকে। বাংলাদেশের ভিতরে থেকে ঝুঁকি নিয়ে সোশ্যাল এ্যক্টিভিস্টরা বিভিন্ন গ্রুপ করে আন্দোলনকারীদের সমর্থন দিয়েছেন। Facebook গ্রুপ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ টেলিগ্রাম গ্রুপ এবং মেসেঞ্জার গ্রুপ করে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আন্দোলনের সংবাদগুলো একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ইউটিউবারদের ধন্যবাদ দেওয়া যায় আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। স্যালুট জানাতে হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজ করে যাওয়া এক্টিভিস্টদের।
৩.
রাষ্ট্রের তৃতীয় স্তম্ভ বিচার বিভাগ। এটাকেও নানা ভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অনৈতিক কাজে সহায়তা করার জন্য বাধ্য করা হয়েছে।শত শত মানুষকে গুম করা বিচার বহির্ভূত হত্যা করা এবং বিনা বিচারে আটক করার মধ্য দিয়ে সমাজে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করা সরকারের জন্য ছিল ডালভাতের শামিল। বিচার বিভাগ ছিল সরকারের তলপিবাহকের মত। বিচারবিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সাধারণ মানুষ ন্যায্য বিচার থেকে হয়েছে বঞ্চিত। কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারকরা আগ বাড়িয়ে নিজেদেরকে অতিমাত্রায় দলীয় নেতা কর্মীর পর্যায়ে নিয়ে যেতেও কুন্ঠাবোধ করেননি।
এক পর্যায়ে বিচারকরা নিজেদের শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ বলে ঘোষণা দেন। এরপর থেকে উচ্চ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদী সরকার তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এই বিচারকদের বিভিন্নভাবে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক এনায়েতুর রহিমের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হককে বিচার কমিশনের আজীবন চেয়ারম্যান করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার জন্য।
আর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে পুরস্কৃত করা হয় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সার্ভিস দেওয়ার জন্য। বিচারক কালা মানিককে পুরষ্কৃত করা হয় জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক থেকে বঞ্চিত করার রায়ের জন্য। কিন্তু প্রকৃতির কি নির্মম প্রতিশোধ ঃ এসব রায় এখন বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল সম্বলিত পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট এখন শুনানি পর্যায়। আশা করা যায় ওই সংশোধনীয় বাতিল হবে এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের রক্ষাকবচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার ফিরে আসবে। যে কালা মানিক এক সময় আদালতের ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন যিনি জ্ঞানীগুণী সম্মানীয় ব্যক্তিদের অপমান অপদস্ত করতেন প্রকাশ্য আদালতে, তাকে কিভাবে সীমান্তে হেনস্থা করা হয়েছে সেটাও দেশবাসী দেখল। তার টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে চোরের মত বেঁধে রাখা হয়েছে ।
যে আদালতে তিনি মানুষকে অপমান করতেন সেই আদালতেই তাকে আবার ডিম ছুড়ে কিল ঘুষি মেরে অপমান অপদস্ত করা হলো। কোন অপকর্ম করে পার পাওয়া যায় না এই কালা মানিক তার শেষ জীবনে এসেও হাড়ে হাড়ে টের পেলেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল জনগণের ভোটাধিকার হাইজ্যাক করেছেন। বিনিময়ে বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আজীবন চেয়ারম্যান হয়েছেন। পেয়েছেন অনেক আর্থিক সুবিধা। কিন্তু জীবন থাকতেই পেলেন অপমান অপদস্ত হওয়ার নতিজা। একসময়ে এই বিচারালয়ের প্রধান বিচারপতি ছিলেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ।কী সম্মান আর ভালোবাসা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি।
বিচারপতি মোস্তফা কামাল কিংবা বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী কিংবা বিচারপতি লতিফুর রহমান -তাদের নাম উচ্চারণ করলে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে।বিগত ১৬ বছরে বিচারালয়কে এমনভাবে কলুষিত করা হয়েছে যে সাধারণ মানুষের আস্থায় ভাটা পড়েছে।
৪.
প্রশাসনের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে পুলিশ এবং বেসামরিক প্রশাসন। গত ১৬ বছর এই দুই প্রশাসনে যত নিয়োগ হয়েছে তার ৯০ শতাংশই ছাত্রলীগ এবং গোপালগঞ্জ ব্যাকগ্রাউন্ডের। ছাত্রদল কিংবা ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কেউ ইন্টারভিউ কার্ড পর্যন্ত পান নাই। এমনকি কোন প্রার্থীর চাচা মামা খালা কেউ যদি বিএনপি কিংবা জামায়াত ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে ন্যূনতম জড়িত থাকেন তাহলেও তাদের ইন্টারভিউ কার্ড পাঠানো হয় নাই। ফলে প্রশাসনে বিএনপি এবং জামাতের কোন নিয়োগ হয়নি গত ১৬ বছরে। এমনকি যারা এই দুটি প্রশাসনে চাকরিরত ছিলেন তাদের কোন প্রমোশন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ওএসডি করে রেখে চাকরির শেষ প্রান্তে এসে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বেসামরিক এই প্রশাসনকে এত সুবিধা দেওয়া হয়েছে যে তারা শেখ হাসিনাকে দেবতা তুল্যো মনে করে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলেই তাদের শণৈ শণৈ উন্নতি হবে। যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত যারা ছিলেন তাদের সুযোগ সুবিধা তো আছেই। তার বাইরে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্যও রাখা হয়েছিল সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা। আর পুলিশের ওসির কথা বাদ দিলাম এসআইদেরও এমন পরিমাণ টাকা পয়সা বানানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে যে তারা শেখ হাসিনা ছাড়া আর কিছুই বোঝেনা। যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে তারা যদি সারাক্ষণ শেখ হাসিনা শেখ হাসিনা করতে থাকে তাহলে বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। বাস্তবে গত ১৫ বছর এমনটাই চোখে পড়েছে শেখ হাসিনার আচরণ এবং বিরোধী দলের কর্মকান্ড দেখে।
গত ১৬ বছর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। জেল জুলুম হুলিয়া মাথায় নিয়ে তারা রাজপথে থেকেছে। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করেছে কিন্তু দিনশেষে সেগুলো সাফল্যের মুখ দেখে নাই। তবে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার চরিত্র উন্মোচন করা সম্ভব হয়েছে। তার দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার আকাঙ্ক্ষার অংশ হিসেবে প্রথমেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র।
শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপকে একান্তই বিচার বিভাগের ওপর দায় চাপালেও মূলত তার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিতে হয়েছে সংসদকে। আর এই দুরভিসন্ধি জনসমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম হয় বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা অন্যান্য রাজনীতি দল। তারা জনগণকে সচেতন করে তুলতে সক্ষম হয়েছে – এটি একটি বড় প্রাপ্তি। শেখ হাসিনার যত অপকর্ম অনিয়ম দুর্নীতি লুটপাট অর্থপাচার স্বজন প্রীতি সম্পর্কে জনগণ এতটাই অবগত ছিল যে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মাতে থাকে।
সেই ক্ষোভ ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে বাঁধতে বারুদের গুদামে পরিণত হয়। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে। সামান্য কোটা সংস্কারকে সামনে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে ছোট আকারে পরবর্তীতে সারাদেশে আন্দোলনে নেমে পড়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলনে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্পুর্ধ অংশগ্রহণ এবং দেশবাসীর সমর্থনে বিদায় নিতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে।
এ আন্দোলন শুধু ছাত্রসমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শ্রমিক রিক্সা চালক কৃষক গৃহবধূ সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল এই আন্দোলন। বিশেষ করে যখন অবুঝ শিশু নিরীহ শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে অকাতরে জীবন দিচ্ছিল তখনই বিদায়ের ঘন্টা বেজে ওঠে শেখ হাসিনার। সারা দেশের মানুষ এক হয়ে অংশ নেয় মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে। দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী সেই কর্মসূচির গভীরতা বুঝতে পেরে হাত তুলে সমর্থন জানায় দেশবাসীকে। আর তাতে গণভবন চলে দিল্লিতে পাড়ি জমাতে হয় শেখ হাসিনাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ শেখ হাসিনা মুক্ত বাংলাদেশ।