এক বছর আগেও তারা ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের অংশ। সরকারি গাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তায় ঢাকার রাস্তায় সাঁই সাঁই করে ঘুরতেন।
আর আজ? আজ তারা দিল্লির, কলকাতার, বেঙ্গালুরুর ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্টে গা ঢাকা দিয়ে আছেন, হাতে আছে শুধু সীমিত সময় আর ভিসা! ক্ষমতার আলো থেকে সরাসরি ‘ভূতের জীবন’—এমন নাটকীয় পরিবর্তন কি তাদের ভাবনায় ছিল?
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। সেই ভারতেই পালিয়ে যান হাসিনার মন্ত্রী, পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক কূটনীতিক, আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে। অনেকের পরিবারও ভারতে।
সেখানে পলাতকদের কেউ কর্মহীন, কারও ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ, আর অনেকের সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছে। সম্প্রতি অবৈধ বা অনিবন্ধিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ভারতের অবস্থান নিয়ে তাদের অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে।
তারা দেশের মাটিতে ফিরতে পারছেন না। কারণ অনেক, তবে মূল সত্য একটাই—তারা দেশে ফিরে কী ঘটবে তা নিয়ে গভীর শঙ্কায় রয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ-১৮ বেশ কয়েকজন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা ও শেখ হাসিনার সরকারের সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের গত এক বছরের অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেছে। তারা অজানা জায়গায়, ভারতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কিছু রাজনৈতিক নেতাদের তত্ত্বাবধানে জীবন যাপন করছেন।
আলো ঝলমলে জীবন থেকে অন্ধকারে ভূতের জীবন
২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর এবং বিক্ষোভ ও ছাত্র আন্দোলন দমন কঠোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভাগ্য নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়। ৫ আগস্টের পর তার অনেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। তবে তারা কখনো আনুষ্ঠানিক নির্বাসনে যাননি, শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবেও নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা ভিসা, পর্যটন ভিসা এবং কূটনৈতিক পাসপোর্টে ভারতে অবস্থান করছেন, যেগুলোর মেয়াদ দ্রুত শেষ হওয়ার পথে।
অনেকেই দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর মতো রাজ্যের বিভিন্ন শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করছেন। তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা এখন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে কূটনৈতিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক পেছনের দরজায় নীরব যোগাযোগে। কাজ করার অনুমতি, কর্মসংস্থান ভিসা বা রাজনৈতিক স্পষ্টতা ছাড়া তারা এক ধরনের ভূতের মতো জীবনযাপন করছেন—চাকরিহীন, রাষ্ট্রহীন এবং আর্থিকভাবে দুরবস্থায়। তাদের সন্তানেরা স্কুল বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছে না। কিছু পরিবার একাধিকবার বাসস্থান পরিবর্তন করেছে স্থানীয় প্রশাসনের নজর এড়াতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য বলেন, আমরা বাঁচার জন্য ভারতে পালিয়েছিলাম, তখন আমাদের ঘরে আগুন দেওয়া হতো, আত্মীয়-স্বজন ও দলের কর্মীদের ওপর হামলা চালানো হতো। ভেবেছিলাম পরিস্থিতি শান্ত হলে কয়েক মাসের মধ্যেই ফিরে আসব। এখন এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। দলের প্রধান (হাসিনা) থেকে কোনো নির্দেশনা নেই। আমরা ভূতের মতো জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশে আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোও ফ্রিজ করা হয়েছে। কিছু নগদ অর্থ নিয়ে আসতে পেরেছিলাম, আর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য পেয়েছি। এখন আমরা বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে এবং সামান্য সঞ্চয়ের ওপর টিকে আছি।
সাবেক এক মন্ত্রী বলেন, আপা (হাসিনা) কয়েক দিন আগে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নীতিনির্ধারকের সঙ্গে দেখা করেছেন। আমাদের এখন নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দল চায় আমরা ফিরে যাই এবং আপার ফেরার পথ প্রস্তুত করি। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। আমরা ফিরলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার হবো।
জ্যেষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, চার বছরের মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে তার বেগ পোহাতে হচ্ছে। ‘কোনো স্কুলই টাকা দিলেও ভর্তি নিচ্ছে না। তারা কিছু নির্দিষ্ট কাগজপত্র চায়, যা আমরা দিতে পারছি না। পুরো পরিবার চিকিৎসা ভিসায় আছে। প্রতিবারই ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে ভিসা বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করতে হয়। ’
আশ্রয়ের সময় ফুরিয়ে আসছে
কমপক্ষে ৩০ জন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা সদস্যরাও ভারতে ভূতের জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ আওয়ামী সরকারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। এখন তারা দেশে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে আছেন অন্তত সাবেক ছয় কূটনীতিক। তাদের কূটনৈতিক সুরক্ষা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। বেশিরভাগই চুপিচুপি তৃতীয় কোনো দেশে আশ্রয়ের ব্যবস্থা খুঁজছেন— কেউ জাতিসংঘের মাধ্যমে, কেউ ব্যক্তিগত আইনজীবীদের সাহায্যে।
সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, ভারত আপাতত অনিচ্ছুক এক আতিথেয়তা প্রদানকারী। তারা আমাদের পরিস্থিতি নিয়ে সহানুভূতিশীল, তবে সরকার আর কোনো সুবিধা দিতে পারছে না। আমরা জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কী। তারা আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে, তাই আমরা অভিযোগ করতে পারি না। তারা কোনো আনুষ্ঠানিক আশ্রয় দেয়নি। কারণ তাদের এমন কোনো নীতি নেই। আমাদের কিছু সহযোগী ইউরোপের কিছু দেশে ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে।
ভারতের বিভিন্ন শহরে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা খুব কঠিন সময়ের মধ্যে আছে। এই কঠিন সময় শিগগিরই শেষ হচ্ছে না। সাবেক এক মন্ত্রী বলেন, সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখা যাচ্ছে না—বরং এমন একটা ঘন অন্ধকার আমাদের ঘিরে ফেলছে, যার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।