জেড নিউজ, ঢাকা:
চলতি বোরো মৌসুমে ৫০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, দুই কোটি ২৬ লাখ দুই হাজার টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, এবার বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে।
ধান উৎপাদনেও অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করবে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার সেচ মৌসুমে দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ছিল নিরবচ্ছিন্ন। কৃষকরা সেচ কাজে এর সুফল পেয়েছেন বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
তবে সময়মতো ফসল ঘরে তোলা নিয়ে চ্যালেঞ্জ দেখছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মাঠের ধান কৃষকের বাড়িতে তোলা পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে পাকা ধান কাটার বিষয়ে করণীয় ঠিক করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতবারের তুলনায় এবার ১৫ লাখ টনের বেশি ধান উৎপাদন হবে। আগাম বন্যা ও প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা রয়েছে বলেও আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। এ সতর্কবার্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ‘পাকা ধান মাঠে থাকবে না’ নীতি ঠিক করেছে। এপ্রিলের এই সময়ে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রও এই সতর্কাবস্থা জারি করে দ্রুত ধান কাটার আহ্বান জানিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, হাওর এলাকায় এরই মধ্যে ৭৫ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। আর সারা দেশে কাটা হয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। এদিকে, গতবারের তুলনায় এবার কেজি প্রতি চার টাকা বেশি দরে কৃষকের কাছ থেকে ধান ও চাল কিনবে সরকার। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ টাকা। আর সিদ্ধ চাল কেনা হবে ৪৯ টাকা কেজি দরে।
বোরো ধানের উৎপাদন বিষয়ে কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, দেশে এবার বোরো ধানের ফলন সন্তোষজনক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব ধান কাটা সম্পন্ন হবে। সরকার এ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে।
হাওরের বুকে কৃষকের হাসি:
সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার ৪৩ শতাংশ এলাকা নিয়ে হাওর অববাহিকা। সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের এ সাতটি জেলার মোট আয়তন প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমির মধ্যে আট লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর হাওর অঞ্চল। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উত্তরে ভারতের মেঘালয় পর্বতমালা, দক্ষিণে ত্রিপুরার পাহাড়, পূর্বে মণিপুরের উচ্চভূমি ও পশ্চিমে বাংলাদেশের মধুপুরের উচ্চভূমি দিয়ে ঘেরা এ হাওরকে দেশের শস্য ভাণ্ডার হিসেবে অধিক গুরুত্ব দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর দেশের হাওরভুক্ত ৭ জেলার হাওরে বোরো ধান আবাদ হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে বোরোর আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। এই জেলায় দুই লাখ ২৩ হাজার ৪১০ হেক্টর আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল। চাষিরা আবাদ করেছেন দুই লাখ ২৩ হাজার ৫০২ হেক্টর জমি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হবিগঞ্জ জেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ২৩ হাজার ৭৩৬ হেক্টর জমি। আবাদ হয়েছে এক লাখ ২৩ হাজার ৮৪৭ হেক্টর। এ ছাড়া সিলেট জেলায় আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ৮৭ হাজার ৫০০ হেক্টরের মধ্যে আবাদ হয়েছে ৮৭ হাজার ৭৩০ হেক্টর। মৌলভীবাজার জেলায় ৬২ হাজার ১০০ হেক্টরের মধ্যে আবাদ হয়েছে ৬২ হাজার ২৩৫ হেক্টর।
চলতি বোরো মৌসুমে বোরো ধানের আশাতীত ফলন হওয়ায় গোটা হাওর এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বোরোর বাম্পার ফলনে কৃষকদের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়েছে। কিশোরগঞ্জ খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা। কিশোরগঞ্জে হাওরের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সোনালি ধানের হাতছানি। কাঁচা-পাকা সোনা রঙের মন জুড়ানো ধানের শিষ হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। হাওরের মাঠে এখন চলছে এসব ধান কাটার ধুম। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন হাওরের কৃষান-কৃষানিরা।
তবে ধানের উৎপাদন ও দাম নিয়ে কৃষকদের মাঝে অসন্তোষ রয়েছে। কৃষকরা বলছেন, খরচ ও ঋণ মেটাতে অনেক চাষি ধান ঘরে না তুলেই বিক্রি করে দিচ্ছেন ৮২০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে। যেখানে এক মণ বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত।
মিঠামইন মহিষের কান্দি গ্রামের কৃষক ফতে আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ফলন ভালো হয়েছে। তবে ধান কাটার মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট রয়েছে এলাকায়। তাই পরিবারের লোকজন ও এলাকার শ্রমিকদের নিয়ে ধান কাটছি। ধানের ন্যায্যমূল্য পেলে আমরা লাভবান হবো।
মহরপুর গ্রামের কৃষক গুনু মিয়া বলেন, আমরা কৃষক মানুষ, ঋণ করে বোরো ধান করেছি। ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এখন দাম ভালো পেলে লাভবান হব। না হলে ঋণের বোঝা বইতে হবে।
হার্ভেস্টার মেশিনের মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে অনেক সময় লাগে। হার্ভেস্টার মেশিন দিয়ে এক একর জমির ধান কাটতে মাত্র এক ঘণ্টা লাগে। মেশিনে ধান কেটে কৃষক সহজেই বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।
কৃষি শ্রমিকের সংকট কাটাতে হাওরে ২২০টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিন ধান কাটার কাজ করছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই বাইরের জেলা থেকে হার্ভেস্টার মেশিন আসছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
হাওরের বাইরেও লক্ষ্যমাত্রার বেশি আবাদ:
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বাংলাদেশে উৎপাদিত চালের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ আসে বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান থেকে। আর উৎপাদিত বোরো ধানের শতকরা ২২ ভাগ পাওয়া যায় হাওর অঞ্চল থেকে। অবশিষ্ট ৭৮ ভাগ ধান আসে হাওরের বাইরের জেলাগুলো থেকে। এর মধ্যে দিনাজপুর হচ্ছে বোরো উৎপাদনকারী অন্যতম জেলা।
হাওর এলাকার বাইরেও দেশের অন্যান্য জেলায় এবার বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ বিষয়ে দিনাজপুরের কৃষি উপপরিচালক মো. জাফর ইকবাল বলেন, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে দিনাজপুর জেলায় এক লাখ ৭৪ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এবার লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত দুই হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষ হয়েছে।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ছিল সেচ মৌসুমে:
পবিত্র রমজান ও সেচ মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জোগান দেওয়া ছিল সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, রমজান, সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের আশঙ্কা ছিল। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে বিদ্যুৎ খাত থেকে হাজার কোটি লুট হয়। মৌসুমের শুরুতেই বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বিগত হাসিনার সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কোনো সিস্টেম বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। হাসিনার পলায়নের পর এ খাতের বিপুল দায়-দেনার বোঝা এসে পড়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। ফলে সেচ মৌসুম, গ্রীষ্মকাল ও রমজান মাসকে সামনে রেখে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জে হয়ে দাঁড়ায়। এই চাহিদা মেটাতে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, কয়লা থেকে ৫ হাজার ৫৫৮ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৪ হাজার ১৪৯ মেগাওয়াট এবং ২ হাজার ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয় সরকারকে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া দেশি-বিদেশি বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ করে জ্বালানি আমদানি করতে হয়।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, গ্রীষ্মে ১৮ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছিল। এ কারণে বাড়তি এলএনজি আনতে হয়েছে। বকেয়া বিল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে সরকার সব ধরনের চেষ্টা করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এবার সেচ মৌসুমে খুবই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না পেলে ধান উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতো। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে কৃষকরা বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন এবার। সময়মতো তারা জমিতে সেচের মাধ্যমে পানি দিতে পেরেছেন।
৪ টাকা বেশিতে ধান-চাল কিনবে সরকার:
চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সাড়ে ১৭ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে সরকার। এর মধ্যে সাড়ে তিন লাখ টন ধান ও ১৪ লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২৪ এপ্রিল থেকে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। গতবারের তুলনায় কেজি প্রতি চার টাকা করে দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ টাকা আর সিদ্ধ চাল কেনা হবে ৪৯ টাকা কেজি দরে।
খাদ্য ও ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার জানিয়েছেন, গতবারের তুলনায় কেজি প্রতি চার টাকা বেশিতে ধান ও সিদ্ধ চাল কেনা হবে।