জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসের জন্য ঘোষিত হতে যাওয়া এ মুদ্রানীতি হবে গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুরের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্রে রেখে আবারও সংকোচনমূলক আরেকটি মুদ্রানীতি দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে আভাস মিলেছে; যেটির বিকল্প বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নেই বলেই মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বৃহ্স্পতিবার নতুন অর্থবছরের প্রথম মুদ্রানীতি দিতে যাচ্ছেন। জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসের জন্য ঘোষিত হতে যাওয়া এ মুদ্রানীতি হবে গভর্নর হিসেবে তার মেয়াদের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগের পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় ব্যবসার ব্যয় কমাতে সুদহার নিম্নমুখী করা কিংবা বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েও এখন খুব বেশি লাভ হবে না।
তবে গত কয়েকটি মুদ্রানীতির মত এবারও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার মধ্যেই প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কৌশল নেওয়া, বিনিয়োগ চাঙা করা এবং কর্মসংস্থানের জন্য গতিশীল আর্থিক পরিবেশ তৈরি করার নীতিগ্রহণকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সময়ের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা।
মুদ্রানীতি প্রণয়নের সঙ্গে কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে নীতি সুদহার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কিছুটা কমিয়ে আনা হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে না আনা পর্যন্ত নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখার পথে হাঁটবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তাছাড়া বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি বাস্তবসম্মত করতে পরের ছয় মাসের জন্য ৭ দশমিক ২ শতাংশ আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে, যা জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে টানা সাত মাস ধরে এ প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ঘরে।
আর পুরো অর্থবছরের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুদ্রানীতিতে এ দুটো বিষয় স্বাভাব্কিভাবে বেশি প্রাধান্য পেলেও দুর্বল ও আর্থিক অনটনে থাকা ব্যাংকগুলো নিয়ে আগামী ছয় মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করতে যাচ্ছে সেটিও থাকা উচিত বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজার এটা প্রত্যাশা করে। আমানতকারী, ব্যাংক ও অন্যান্যরা এ বিষয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেই কমবে নীতি সুদহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যের চেয়ে মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, যতটুকু আভাস মিলেছে তাতে এবার বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার পরির্তন করছে না; সংকোচনশীল ধারাই বজায় থাকবে।
তবে তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও স্পষ্ট করে বলতে হবে যে এ অপরিবর্তিত নীতি সুদহার আর কতদিন বজায় রাখা হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে লক্ষ্য ছিল তারচেয়ে এখনও মূল্যস্ফীতি আড়াই থেকে ৩ শতাংশের ওপরে। এমন অবস্থায় নীতি সুদহার এখন কমাবে নাকি মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যের কাছাকাছি এলে কমানো হবে সে বিষয়টি মুদ্রানীতিতে থাকা উচতি।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জুনের মূল্যস্ফীতির তথ্য বলছে, সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে।
বিনিয়োগের জন্য চাই ছাড়
নীতি সুদহার চড়া থাকলে বিনিয়োগে ভাটার টান আসে। সুদহার বেড়ে গেলে ব্যবসার ব্যয় বাড়তে থাকে যা উদ্যোক্তাদের হাত গুটিয়ে রাখার দিকে ঠেলে দেয়। তাই দীর্ঘসময় যেন সুদহার বাড়তেই না থাকে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “সংকোচনশীল মুদ্রানীতি ঘোষণা হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তবে নীতি সুদহার না নামালে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়বে। তাতে নতুন বিনিয়োগ কম হবে। তাই নীতি সুদহার সামনে কমিয়ে আনা উচিত।
“নতুন বিনিয়োগ কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। কারণ বিনিয়োগ না বাড়াতে পারলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে না। কিন্তু সেটা আমরা দেখতে পারছি না।“
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ ছাড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে যা ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এ হিসাব বলছে, টানা সাত মাস থেকে বেসরকার খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ার ঋণ বাড়ার হার ৮ শতাংশের নিচে রয়েছে
’বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি না হলে সুদহার কমিয়ে লাভ নেই’
বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি না হলে ঋণের সুদের হার কমালেও তা কাজে আসবে না। বরং আরো ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
এ কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই বলেও মনে করছেন তিনি। বলেন, “কারণ এখন তো বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। টাকার সরবরাহ বাড়ালে তা আরো ঝুঁকি তৈরি করবে। কারণ বিনিয়োগ ইতিবাচক হওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণ।”
‘মূল্যস্ফীতি কমানোর একটি সুযোগ হাতছাড়া’
ডলারের দর নিম্নমুখী হওয়ার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে সুযোগ এসেছিল তা বাংলাদেশ ব্যাংক কাজে না লাগানোর সমালোচনা করেছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন। বলেন, ডলার দর কমতে না দিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে কিনে তা বাড়িয়ে রাখার প্রবণতা দেখা গেছে।
“এটা কেনার সঠিক সময় এখন ছিল কিনা সেটা একটা বিষয়। সেক্ষেত্রে আরেকটা নতুন ঝুঁকি কেন তৈরি করা হল।“