এবার ঘাটতি বাজেট ৪ শতাংশের নিচে রাখার লক্ষ্য অন্তর্বর্তী সরকারের, বলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নিতে যাচ্ছে সরকার, যা সংশোধিত এডিপির প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ বেশি।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল এডিপি কমিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় সংশোধন করে। এ হিসাবে আসছে অর্থবছরে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের আকার বাড়ছে ১৪ হাজার কোটি টাকা বা প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ।
রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদন হওয়া প্রস্তাবিত এডিপির আকার গত অর্থবছরের মূল এডিপির (২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় ৩৫ হাজার কোটি বা ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ কম।
এনইসির অনুমোদনের পর এখন জাতীয় বাজেটে এডিপি চূড়ান্ত করবে সরকার।
প্রধান উপদেষ্টা ও এনইসির চেয়ারপারসন মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
আগের অর্থবছরের মূল এডিপির চেয়ে টাকার অঙ্কে প্রস্তাবিত এডিপি ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমানোর ব্যাখ্যায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “এবার আমরা বরং বাজেটকে আমি যদি বলি ছোট করছি। ছোট ঠিক না বাস্তবসম্মত করছি।”
প্রস্তাবিত এডিপিতে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনের প্রকল্পসহ মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৯৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে এ বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নের পরিমাণ ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে ১ হাজার ১৪৩টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ধরা হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ (প্রায় ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা) খাতে, যা মোট অনুমোদিত এডিপির ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
এর পরের অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি (প্রায় ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি) খাত, যা মোট এডিপির ১৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলী খাতে প্রায় ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
সভা শেষে ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “এবারে গতবারের মূল বাজেটের সঙ্গে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনা করাটা একটু ঠিক হবে না। কারণ এবারের বাজেটে তো আর গত বছরের উন্নয়ন বাজেটের সে সমস্যাগুলো নাই।
“এবার আমরা বরং বাজেটকে আমি যদি বলি ছোট করছি। ছোট ঠিক না বাস্তবসম্মত করছি। এখন তো আমরা বুঝে গেছি যে বাস্তবায়নের সমস্যাগুলা কী এবং কাজেই যেই প্রকল্পগুলো এখন চালু থাকবে আমরা আশা করব সেগুলো বাস্তবায়ন দ্রুততার হবে এবং সেগুলোতে অপচয় অনিয়ম কম হবে বলে আশা করছি।”
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় সব খাতেই বরাদ্দ বেশি থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “খুব সম্ভব শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য খাতে অতটা বাড়ানো যায়নি উন্নয়ন বাজেটে।”
অন্তর্বর্তী সরকার বারবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলে এলেও স্বাস্থ্যে না বাড়ার ব্যাখ্যায় উপদেষ্টা বলেন, “কারণ স্বাস্থ্যের সমস্যাটা ছিল, উপজেলায় ও জেলা পর্যায়ে অনেক অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ওগুলো কোথাও চালু নেই। কোথাও ডাক্তার নাই। কোথাও যেসব সরঞ্জাম দরকার, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম দরকার, সেগুলো নাই।
আসছে অর্থবছরের বাজেটের কৌশল ও লক্ষ্য কী হবে তা তুলে ধরে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “আমরা একটা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার জন্য, মূল্যস্ফীতি কম রাখার জন্য, কমিয়ে আনার জন্য এবং বাজেট ব্যবস্থাপনাকে এই বছর থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে যাতে বাজেট ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা ফিরে আসে, টেকসই হয় বাজেট ব্যবস্থাপনা সেটাই এ বছরের বাজেটের আসল লক্ষ্য।
“টেকসই মানে হল যে ঋণের ফান্দে পড়ে না যায় যেন। ক্রমাগতভাবে ঘাটতি বাজেট করে তারপর আবার সেটা ঋণের বোঝা হয়। বৈদেশিক ঋণই হোক বা দেশের ভিতর থেকে ঋণ হোক। ঘাটতি বাজেট করে পরবর্তীতে আবার ঋণ পরিশোধের চাপে পড়তে হয়। তো সরকারের পরিচালন ব্যয়ই হোক সেটা অথবা উন্নয়ন বাজেট হোক সেগুলার ওপর ঋণের চাপ পড়ে। এই দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এবার বাজেট।”
এর জন্য ঘাটতি বাজেট সাধারণত জিডিপির ৫ শতাংশের আশেপাশে থাকলেও এবার তা ৪ শতাংশের নিচে রাখার লক্ষ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বলে তুলে ধরেন উপদেষ্টা।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “যেহেতু রাজস্ব বৃদ্ধি করা যাবে না হঠাৎ করে। চেষ্টা হবে এ বছর থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি করার। সর্বাত্মক চেষ্টা হবে। কিন্তু তা সত্যও যাতে ব্যয় সীমিত থাকে এবং বাজেটের ঘাটতি কম থাকে। এবং সেটা আমরা জিডিপির ৪ শতাংশের নিচে রাখার চেষ্টা করছি।”
‘দায়িত্বজ্ঞানহীন বাজেট হবে না’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, “আমি বলব যে এবারের বাজেট শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের বাজেট। তার মানে হল অন্যভাবে বলতে গেলে এটা কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন বাজেট হবে না। এখানে এমন ব্যয়ে থাকবে না যেটা সাময়িকভাবে মনে হবে জনতুষ্টির কিন্তু আসলে পরে এর দায় গিয়ে পড়বে পরবর্তী বাজেটের বা আরও পরের বছরের বাজেটের উপর।”
বর্তমান সরকার মেগাপ্রকল্প নেবে না বলেও ফের তুলে ধরেন এ উপদেষ্টা। বলেন, সরকার কোনো মেগাপ্রকল্প নিচ্ছে না এবং বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের ঋণ না নিয়ে দীর্ঘ সময় ও কম সুদের ঋণ নিচ্ছে। ঋণের বোঝা কমাতে আগের বিদেশি ঋণের দায়ও মেটানো হচ্ছে।