এমন ভয়কে ‘দুঃখজনক’ বলছেন ব্যবসায়ী নেতারা, যাদের মধ্যস্ততায় শাটডাউন কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।
চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবি থেকে সরে দাঁড়ানোর পর বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর আর বদলির আতঙ্কে থাকার কথা বলছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মীরা।
তারা বলছেন, কাজে মনোযোগ দিতে ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে, আর কিছু হবে না’–এমন একটা নিশ্চয়তা তারা চান। শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ভয়ে তারা কাজে ফিরলেও ঠিকঠাক মনোযোগ দিতে পারছেন না।
এনবিআর কর্মীদের মধ্যে এমন আতঙ্ক তৈরি হওয়ার বিষয়টিকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা, যাদের মধ্যস্ততায় মূল ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, “আমরা যখন মিটিং করছিলাম ওদের (আন্দোলনরত) সঙ্গে, ফাইনাল মিটিং, এটা করার আগে আমরা প্রথমে আরেকটা মিটিং করি।
“তাদের সঙ্গে বসে আমাদের মোটামুটি আলোচনা হল। তারপরে গেলাম অর্থ উপদেষ্টার কাছে। ওখানে এনবিআর চেয়ারম্যান সাহেবও ছিলেন। তো বললাম যে ওরা আন্দোলন প্রত্যাহার করবে, আমাদের কথা দিছে। ওদের একটু ভয়ভীতি কাজ করতেছে।”
সেখানে কী কথা হয়েছিল তা তুলে ধরতে গিয়ে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “আমরা বলেছিলাম, তাদের দোষ থাকতে পার, এগুলোতে এখন হাত দিয়েন না। তাহলে হয় কি, একটা ইমপ্রেশন হবে যে আন্দোলনের জন্য তাদের শাস্তি দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ‘জেনুইন’ অন্যায় করলে তাদের আস্তেধীরে আইনের আওতায় আনার পরামর্শ ছিল ব্যবসায়ীদের।
এ বিষয়ে আলোচনার জন্য ব্যবসায়ীরা ফের অর্থ উপদেষ্টার কাছে সময় চেয়েছেন তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেখানে গিয়ে বলতে চাই যে, ‘স্যার একদম ঠিক হচ্ছে না’।”
কবে আলোচনা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তিন দিন সরকারি বন্ধ। ছুটির পর সময় পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।
একইরকম উদ্বেগের কথা তুলে ধরে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নবনির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “আমাদের তরফ থেকে আমরা ইনফরমালি এনবিআর চেয়ারম্যান তারপরে অর্থ উপদেষ্টা মহোদয়কে জানিয়েছি।
“আমাদের সিনিয়র লিডার মাহবুব ভাই (ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান) ওনার (অর্থ উপদেষ্টা) সাথে যোগাযোগ করছেন। এক্সাক্টলি বলা হয়েছে যে এভাবে করলে তো তারা ডিমোরালাইজ থাকবে।”
এভাবে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া চলমান থাকলে এবং তারা ‘ডিমোরাইলাইজড’ হলে দেশের সবারই ‘ক্ষতি’ বলে তুলে ধরেন তিনি।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, “যদি কারো বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে এটা তদন্ত করা উচিত। এটা সময় নিয়ে দেখা উচিত।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার ফলে তিনি এ সমস্যা সমাধানে আশার কথাও শোনান।
কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক নিয়ে তাদের ‘কনসার্ন’ জানিয়ে একটি চিঠিও লেখার কথা অর্থ উপদেষ্টাকে।
এনবিআরে সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে জুনে চেয়ারম্যানকে অপসারণে এনবিআরে আন্দোলন শুরু হয়।
এর আগে মে মাসে এনবিআর দুই ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব নীতি নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। সেই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
তাদের আন্দোলনের মধ্যে সরকার পিছু হটে। ২২ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অধ্যাদেশে ‘প্রয়োজনীয় সংশোধনী’ আনা হবে। আর সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান কাঠামোতেই চলবে এনবিআরের সব কাজ।
সরকারের এমন ঘোষণাতেও আন্দোলন অব্যাহত থাকলে তিন দিন পর (২৫ মে) অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এনবিআর বিলুপ্ত হবে না, বরং এ সংস্থাকে ‘স্বাধীন ও বিশেষায়িত’ বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করা হবে। এজন্য ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশে সংশোধন আনার কথাও বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এর মধ্যে সংস্থাটির কর্মীরা নানা অভিযোগে এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে নতুন করে আন্দোলনে নামেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন।
দাবি আদায়ে ২৮ জুন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেন এনবিআর কর্মীরা। তাদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রপ্তানিসহ এনবিআরের কার্যক্রম।
পরের দিন (২৯ জুন) কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে সংস্থাটির সেবাকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
সংকট নিরসনে সেদিন এনবিআর কর্মীদের অবিলম্বে কর্মস্থলে ফেরা এবং আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানায় সরকার। এ আহ্বানে সাড়া না দিলে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে।
পরে সংকট সমাধানে পাঁচ উপদেষ্টাকে নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করার কথা জানায় সরকার।
দিনভর নানা নাটকীয়তার পর রাতে ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকটি সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন অর্থ উপদেষ্টা। সেখানেই মেলে সমাধানের সূত্র।
ওই বৈঠকে ‘ইতিবাচক আশ্বাসের’ ভিত্তিতে ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের মধ্যস্থতায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ শাটডাউন কর্মসূচি তুলে নেয়।
র্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরও আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের ‘দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধানে’ নামে দুদক। তিন দফায় ১৬ জনের তথ্যানুসন্ধান শুরুর তথ্য দেয় সংস্থাটি।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান।
এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি বলেন, “ট্যাক্স ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করার সময় দুদক বিশেষভাবে তাদেরই টার্গেট করছে, যারা সম্প্রতি এনবিআর সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যদি এটি সত্য হয়, তাহলে এটি ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’।
“আমি বলছি না যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো যাবে না বা করা উচিত নয়। এটি তো দুদকের দায়িত্বের অংশ। কিন্তু যদি আবারও এই প্রতিষ্ঠানকে সরকার ভিন্নমত দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে বোঝা যায়, আমরা ‘আসলে একটুও বদলাইনি’।”
সরকারের এ ধরনের কাজকে ‘অপচেষ্টা’ আখ্যা দিয়ে এটিকে পূর্বের অবস্থা টিকিয়ে রাখার নমুনা হিসেবেই দেখছেন তিনি।
এনবিআরের আন্দোলনে সামনের সারির এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন যেটা হচ্ছে, আপনার রাজস্ব প্রশাসনে আসলে কাজের যদি আপনার আন্তরিকতা না থাকে, তাহলে আপনার রাজস্ব আদায় করাটা ‘কঠিন’ হয়ে পড়ে।”
এখন সব পর্যায়ের মধ্যে ‘অস্থিরতা-ডিপ্রেশন’ চলছে তুলে ধরে তিনি বলেন, “বলতে পারেন যে এক ধরনের ভয়ভীতি চলছে।
“এটা একটা বড় সমস্যা। এটা যত দ্রুত দূর করা যাবে, মানে যত দ্রুত এটাকে সবাই ভাবতে পারবে যে, যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, আর কিছু হবে না, তত দ্রুতই আসলে মনোনিবেশ করতে পারবে কাজে।”
এসব বিষয়ে কথা বলতে ফোনে একাধিকবার এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। ফোন করে অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যও মেলেনি।
এনবিআরের সংকট নিরসনে যে পাঁচ উপদেষ্টাকে নিয়ে কমিটি করা হয়, তার সভাপতি হিসেবে আছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। ফোন করে এবং বার্তা পাঠিয়ে তারও সাড়া পাওয়া যায়নি।