২০০৩ সালে জাতিসংঘের পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইরান গোপনে ১৮ বছর ধরে পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। এতে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
ইরান সবসময়ই বলে আসছে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ মনে করে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রেসিডেন্ট আলোচনা ও চাপ দিয়ে আসছেন। কেউ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, কেউ আবার চুক্তি করেছেন। ২০১৫ সালে একবার সমঝোতা হলেও পরে তা ভেঙে যায়। এরপর ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মিলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। তবে এতে আসল ক্ষতি কতটা হয়েছে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। অথচ ইরানের এই কর্মসূচির শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই।
১৯৫৩ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘পারমাণবিক প্রযুক্তি যখন সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়, তখন তা মানবজাতির জন্য ভয়ানক হুমকি হয়ে ওঠে। ’ তিনি জাতিসংঘের অধীনে একটি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন, যার কাজ হবে পারমাণবিক পদার্থকে মানবকল্যাণে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। তিনি এই শক্তিকে জ্বালানি, চিকিৎসা, কৃষি ও অন্যান্য শান্তিপূর্ণ প্রয়োজনে ব্যবহারের আহ্বান জানান।
আইজেনহাওয়ারের ভাষণের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। একইসঙ্গে শুরু হয় ‘অ্যাটমস ফর পিস’ বা শান্তির জন্য পরমাণু নামে একটি বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি। এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে শিক্ষা ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া শুরু করে। ১৯৫৫ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণে সহায়তা এবং ‘মুক্ত বিশ্বের’ দেশগুলোর কাছে সীমিত পরিমাণে বিভাজনযোগ্য পদার্থ রপ্তানির অনুমতি দেয়।
পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা পিটার আর. লাভয় বলেন, ‘এই রপ্তানির মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখা, সোভিয়েত প্রভাব কমানো এবং বিদেশি ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের উৎসে সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। ’ এই কর্মসূচির প্রথম সুবিধাভোগী দেশ ছিল ভারত। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসরায়েল, তুরস্ক, পাকিস্তান, পর্তুগাল, গ্রিস, স্পেন, আর্জেন্টিনা
ব্রাজিল এবং ইরানও যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সহায়তা পেতে শুরু করে।
১৯৫৭ সালের ৫ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি হয়। তখন ইরানের শাসক ছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরানে ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির আওতায় পারমাণবিক কর্মসূচির ভিত্তি স্থাপন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে, কোল্ড ওয়ারের সময় ইরান ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত দেশ। উইলসন সেন্টারের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, তৎকালীন মার্কিন নথি থেকে জানা যায়, নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা ইরানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কৌশলের মূলভিত্তি হিসেবে ধরা হতো এবং পারমাণবিক কর্মসূচির মাধ্যমে ইরানকে পশ্চিমা জোটের প্রতি অনুগত রাখা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য।
১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানকে একটি পাঁচ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি দেয়। সেই সঙ্গে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামও দেওয়া হয়, যা চুল্লি চালাতে প্রয়োজন ছিল। ১৯৭০ সালে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) স্বাক্ষর করে। এতে ইরান প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে না। তবে শাহের মনে অস্ত্র তৈরির চিন্তা তখনো রয়ে যায়। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক আকবর এতেমাদ বলেন, শাহ আমাকে বলেছিলেন, যদি ইরান শক্তিশালী হয়, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। তবে যদি পরিস্থিতি বদলায়, তাহলে পারমাণবিক পথেই হাঁটতে হবে। তার মনে সেই প্রস্তুতি ছিল।
১৯৭৪ সালে গঠিত হয় ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা। তখন এর চেয়ারম্যান ছিলেন আকবর এতেমাদ। তার নেতৃত্বেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিস্তার শুরু হয়। শাহ ঘোষণা দেন, আগামী দুই দশকে ইরানে ২৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে, যার প্রত্যেকটির উৎপাদন ক্ষমতা হবে প্রায় ২৩ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু বড় সমস্যা ছিল, ইরানে পারমাণবিক প্রকৌশলী ও পদার্থবিজ্ঞানীর ঘাটতি। গবেষণা চুল্লি চালানোর মতো দক্ষ জনবলই ছিল না। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন জানায়, ‘প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে ইরানের গবেষণা চুল্লি প্রায় এক দশক ধরে অচল পড়ে ছিল।
১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি-তে (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) একটি মাস্টার্স প্রোগ্রামের প্রস্তাব দেয়। এই কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল ইরানের প্রথম প্রজন্মের পারমাণবিক প্রকৌশলী তৈরি করা। প্রথম দুই বছরের জন্য ইরান ওই প্রোগ্রামে ১৩ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে। তবে এমআইটির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। তাদের আশঙ্কা ছিল, ইরান এই প্রযুক্তি অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া শাহের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েও আপত্তি ওঠে।
তবে ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতা হারালে ওয়াশিংটন-তেহরানের পারমাণবিক সহযোগিতা পুরোপুরি থেমে যায়। প্রযুক্তি ইতিহাসবিদ স্টুয়ার্ট ডব্লিউ. লেসলি ও রবার্ট কারগন বলেন, ‘এমআইটি-তে তখন কেউ কল্পনাও করেনি, শাহের জন্য তৈরি করা প্রোগ্রাম এত দ্রুত ইসলামী বিপ্লবীদের হাতে চলে যাবে। অনেক ইরানি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়াবেন—এটা কেউ ভাবেননি। ’
এমআইটির আদলে গড়ে তোলা ইরানের আরিয়ামেহর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি বিপ্লবের সময় ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামি সরকার পারমাণবিক প্রকল্প বাতিল করে দেয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মোহাম্মদ হোমায়ুনভাশ বলেন, “ইরানের নতুন শাসকেরা মনে করতেন, পারমাণবিক প্রকল্প শাহের ‘সাদা হাতি’—অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল। তারা প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয় এবং পাঁচ-ছয় বছর পুরোপুরি অবহেলা করে। তাদের ধারণা ছিল, ইরানের প্রচুর তেল রয়েছে, তাই পারমাণবিক শক্তির দরকার নেই। ” কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব পারমাণবিক প্রযুক্তির কৌশলগত গুরুত্ব বুঝতে পারে। তারা দেশত্যাগী বিশেষজ্ঞদের ফেরানোর চেষ্টা করে এবং গোপনে নতুন পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে।
অ্যাটমস ফর পিস’ প্রকল্প কীভাবে ইরানের মতো দেশের পারমাণবিক কর্মসূচিকে প্রভাবিত করেছিল- এমন প্রশ্ন নানা সময়েই এসেছে। অধ্যাপক হোমায়ুনভাশ বলেন, ‘আইজেনহাওয়ারের মূল উদ্দেশ্য ছিল—যেন আরও দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের পথে না হাঁটে। ধারণা ছিল, যদি তাদের নির্দিষ্ট সীমায় শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরেনিয়াম বিক্রি করত না। গবেষণার জন্য সীমিত পরিমাণ ইউরেনিয়াম ভাড়া দিত, যা চুল্লির জ্বালানির জন্য ব্যবহৃত হতো। ’
এভাবে প্রায় ৩০টি দেশে পারমাণবিক গবেষণার সুযোগ তৈরি হয়। তবে ‘অ্যাটমস ফর পিস’ প্রকল্প আসলেই পারমাণবিক বিস্তার ঘটিয়েছে কি না—এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধ্যাপক হোমায়ুনভাশ বলেন, ‘এই প্রকল্প একটি পরিবেশ তৈরি করেছিল, যেখানে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু একবার দেশগুলো প্রযুক্তির ব্যবহার শিখে গেলে, তারা নিজেদের মতো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
তিনি মনে করেন, ‘অ্যাটমস ফর পিস’ না থাকলে অনেক দেশ পারমাণবিক শক্তি পেত না—এ কথা সরলভাবে বলা যায় না। এটি জটিল বিষয়। অন্যদিকে, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আইজেনহাওয়ারের এই উদ্যোগ পারমাণবিক বিস্তারকে উৎসাহিত করেছে।
জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক জন ক্রিগে বলেন, ‘নতুন গবেষণা দেখাচ্ছে, এই উদ্যোগ বিপজ্জনক ছিল এবং পারমাণবিক কর্মসূচির বিস্তারকে সহায়তা করেছে। তখন মনে করা হয়েছিল, শান্তিপূর্ণ ও সামরিক পারমাণবিক প্রযুক্তির মধ্যে স্পষ্ট রেখা টানা সম্ভব। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, এই ধারণা ভুল ছিল। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে বড় প্রভাব ফেলেছে—এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
বিশেষজ্ঞরা ভারত ও পাকিস্তানের উদাহরণ দেন। এই দুই দেশের প্রথম পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং পরে পারমাণবিক বোমা তৈরি করেন। তবে এই বিশ্লেষণে শুধু বিস্তার নয়, প্রতিরোধের ঘটনাগুলোর কথাও বিবেচনা করতে হবে। পিটার আর. লাভয় লিখেছেন, “অনেক সময় দেখা গেছে, শান্তিপূর্ণ গবেষণার উপকরণ সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য সরানোর চেষ্টা ধরা পড়েছে এবং তা ব্যর্থ করা গেছে। এটি সম্ভব হয়েছে ‘অ্যাটমস ফর পিসে’র অধীনে গড়ে ওঠা নিরাপত্তা কাঠামোর কারণে। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া এর উদাহরণ