মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শুক্রবার আলাস্কার আঙ্কোরেজে বৈঠকে বসবেন। এতে মূল আলোচ্য বিষয় ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি।
হোয়াইট হাউস জানায়, দুই বিশ্বনেতার নিরাপত্তা মানদণ্ড পূরণ করে, এমন সব ব্যবস্থা এই ঘাঁটিতে রয়েছে। তাড়াহুড়ো করে আয়োজিত বৈঠকের জন্য অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
ট্রাম্পের উদ্যোগে এই গ্রীষ্মে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তিন দফা আলোচনা হলেও, তাতে দুই পক্ষ এখনও শান্তির পথে কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি।
জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন কী?
কোল্ড ওয়ারের সময় থেকে এই ঘাঁটি আলাস্কার বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি। ৬৪ হাজার একর আয়তনের এই স্থাপনা আর্কটিক অঞ্চলের সামরিক ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ঘাঁটিটি বরফে ঢাকা পাহাড়, বরফজমা হ্রদ এবং চিত্রাকর্ষক হিমবাহে ঘেরা। এতে শীতকালে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নেমে যায়, তবে বৈঠকের দিন শনিবার প্রায় ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকতে পারে।
ট্রাম্প ২০১৯ সালে তার প্রথম মেয়াদে ঘাঁটিটি পরিদর্শন করেন এবং বলেন, এখানকার সৈন্যরা আমাদের দেশের শেষ সীমান্তে আমেরিকার ঢাল হিসেবে কাজ করছেন।
ঘাঁটিতে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করে। এই সংখ্যা আঙ্কোরেজ শহরের বাসিন্দাদের তুলনায় ১০ শতাংশ।
১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঘাঁটি স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি প্রতিহত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিমান প্রতিরক্ষা ও কেন্দ্রীয় কমান্ড পয়েন্ট হিসেবে কাজ করত।
১৯৫৭ সালে ওই ঘাঁটিতে ২০০টি যুদ্ধবিমান মোতায়েন ছিল এবং বহু বিমান নিয়ন্ত্রণ ও অ্যাডভান্সড রাডার সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছিল, যার কারণে এটি ‘টপ কভার ফর নর্থ আমেরিকা’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
কৌশলগত অবস্থান ও প্রশিক্ষণ সুবিধার কারণে ঘাঁটিটি ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।
কেন আলাস্কায় বৈঠক হচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্র ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নেয়। এই ঘটনা বৈঠকটিকে ঐতিহাসিক মাত্রা দিতে যাচ্ছে। ১৯৫৯ সালে এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্য হয়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সহকারী ইউরি উশাকভ বলেন, দুই দেশ প্রতিবেশী এবং কেবল বেরিং প্রণালীই তাদের আলাদা করে।
তিনি বলেন, আমাদের দল সহজেই বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে এখানে আসতে পারে, তাই দুই দেশের নেতাদের এই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রত্যাশিত বৈঠক আলাস্কায় হওয়াই যৌক্তিক।
আলাস্কা সর্বশেষ আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিল ২০২১ সালের মার্চে, যখন জো বাইডেনের নতুন কূটনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা দল আঙ্কোরেজে চীনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছিল।
সেই বৈঠক বিরোধপূর্ণ হয়ে যায়। তখন চীনা পক্ষ অভিযোগ করে, আমেরিকানরা তাদের ওপর কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে এবং কথাগুলো বলার সময় কিছুটা ছদ্মবুদ্ধিমত্তা বা ভণ্ডামির আশ্রয় নিয়েছে।
পুতিন ও ট্রাম্প কেন বৈঠক করছেন?
ট্রাম্প ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ করতে অনেক চেষ্টার পরও তেমন সাফল্য পাননি।
প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, শপথ নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন। এ ছাড়া তিনি বারবার বলেছেন, যদি ২০২২ সালে রাশিয়ার আগ্রাসনের সময় তিনি প্রেসিডেন্ট হতেন, তবে এই যুদ্ধ হতোই না।
গত মাসে ট্রাম্প বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, তিনি পুতিনের প্রতি অসন্তুষ্ট। যুদ্ধ শেষ না হওয়ায় ট্রাম্প ৮ আগস্ট পর্যন্ত পুতিনকে সময় দিয়েছিলেন। তখন বলা হয়েছিল, এই সময়ে যুদ্ধ শেষ না করলে যুক্তরাষ্ট্র আরও কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
সময়সীমা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি ও পুতিন ১৫ আগস্ট ব্যক্তিগত বৈঠকে বসবেন।
এই বৈঠক এমন সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বুধবার মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেন। ট্রাম্পের মতে, এই আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ।
বৈঠকের আগে হোয়াইট হাউস জোর দিয়ে বলে যে, দুই পক্ষের এই বৈঠক সরাসরি যুদ্ধবিরতির দিকে নিয়ে যাবে এমন ধারণা অতিরঞ্জিত।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লিভেট বলেছেন, প্রেসিডেন্ট মূলত অন্য পক্ষের কথা শুনবেন এবং পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবেন।
সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, তিনি এই শীর্ষ বৈঠককে পরিস্থিতি বোঝার বৈঠক হিসেবে দেখছেন।
ইউক্রেন কি অংশ নিচ্ছে?
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই বৈঠকে সরাসরি অংশ নেবেন, এমন আশা করা হচ্ছে না। সোমবার ট্রাম্প বলেন, তাকে বলতাম, তিনি আসতে পারেন, তিনি এরইমধ্যেই অনেক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
তবে ট্রাম্প আরও বলেন, বৈঠকের পর তিনি প্রথম জেলেনস্কিকেই ফোন করবেন।
পরে হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা জানান, ট্রাম্প ও জেলেনস্কি বুধবার বৈঠক করবেন। এই ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে কয়েকজন ইউরোপীয় নেতা অংশ নেবেন। সে অনুযায়ী ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের কথা হয়।
পুতিন চাইছিলেন, জেলেনস্কি বৈঠক থেকে বাদ থাকুন, যদিও হোয়াইট হাউস আগেই জানিয়েছিল যে ট্রাম্প চাইলে তিন নেতার উপস্থিতিতে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও হতে পারে।
জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেনের মতামত ছাড়া যেকোনো চুক্তি হবে অকার্যকর।
দুই পক্ষের লক্ষ্য কী?
যদিও রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষই যুদ্ধ শেষ করতে চায়, তাদের দাবির মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব রয়েছে।
সোমবার ট্রাম্প বলেন, তিনি ইউক্রেনের জন্য কিছু রুশ দখলকৃত অঞ্চল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। তবে সতর্ক করে বলেন, এর জন্য কিছু এলাকা বিনিময় বা পরিবর্তন করতে হতে পারে।
ইউক্রেন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, ক্রিমিয়ার মতো স্থান মস্কোর দখল তারা মেনে নেবে না। জেলেনস্কি বলেছেন, আমরা রাশিয়াকে তার অপরাধের জন্য পুরস্কৃত করব না।
অন্যদিকে, পুতিন তার ভূখণ্ড দাবি, ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা ও সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ আকার নিয়ে ভাবনা থেকেও একটুও সরে আসেননি।
পুতিন মনে করেন, পশ্চিমা প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটো ইউক্রেনকে ব্যবহার করে তাদের সেনারা রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপীয় নেতাদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে এমন এক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে, যা ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল রাশিয়ার হাতে তুলে দেবে।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, এই চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ রাখবে এবং ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দনবাস অঞ্চল দখল করবে, যা দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক নিয়ে গঠিত।
রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় আক্রমণ করে এবং তাদের সেনারা দনবাস অঞ্চলের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নেয়।
চুক্তির আওতায়, রাশিয়াকে ইউক্রেনের খেরসন এবং জাপোরিজিয়ারিয়ার অঞ্চল ছাড়তে হতে পারে, যেখানে বর্তমানে তাদের কিছু সামরিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।