জানুয়ারি মাসে হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের মাত্র কয়েকদিন পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ দুর্ভেদ্য বর্মে ঢেকে ফেলার জন্য নতুন এক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন তিনি।
তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার ভবিষ্যৎ এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘গোল্ডেন ডোম’ তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ‘সম্পূর্ণভাবে চালু’ হয়ে যাবে। খবর বিবিসি বাংলার।
প্রথম ধাপে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাম্প বলেন, পুরো প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার হবে বলে তিনি ধারণা করছেন। তবে কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, এর প্রকৃত খরচ চূড়ান্ত পর্যায়ে কমপক্ষে এর তিন গুণ হতে পারে।
এই পরিকল্পনায় স্থল, সমুদ্র এবং মহাকাশ জুড়ে ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের’ প্রযুক্তির একটি নেটওয়ার্ক থাকবে। এর মূল অংশ হবে মহাকাশভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর ও সেন্সর– যা শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হবে।
গোল্ডেন ডোম বিদ্যমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হলেও আরও বিভিন্ন বাড়তি সংযোজন থাকবে। বর্তমান সময়ে ক্রমাগত বাড়তে থাকা অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা হুমকি, উদাহরণস্বরূপ রাশিয়া বা চীনের দিক থেকে সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেবে।
আয়রন ডোম ও গোল্ডেন ডোমের পার্থক্য
গোল্ডেন ডোম, আয়রন ডোমের মূল লক্ষ্য এক। শত্রুর ছোড়া ব্যালেস্টিক বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান থেকে জনসাধারণ ও সামরিক কৌশলগত সম্পত্তিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এগুলোকে তৈরি করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে ‘গোল্ডেন ডোম’ তৈরি করতে যাচ্ছে, তার কার্যপদ্ধতি হবে সম্পূর্ণ আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রের এই হাতিয়ারটি হবে সম্পূর্ণ মহাকাশভিত্তিক। এর মাধ্যমে ইনফ্রারেড লেজার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে শত্রুর ছোড়া ব্যালেস্টিক বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করবে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর জন্য স্থলভিত্তিক রেডারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে এই ব্যবস্থা। তারপর লেজার ব্যবহার করে হাইপারসনিক, ব্যালেস্টিক এবং ক্রুজ- তিন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করবে গোল্ডেন ডোম।
বর্তমানে এজিস বিএমডি বা ব্যালেস্টিক মিসাইল ডিফেন্স নামের একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে মার্কিন নৌবাহিনী। এতে রয়েছে এসএম-২ নামের ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র। মূলত রণতরীগুলোকে রুশ আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে এটি মোতায়েন রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনা। ২০০৯ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে এজিস বিএমডির সাহায্যে যুদ্ধজাহাজগুলোকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে মার্কিন মুলুক।
এছাড়া মার্কিন সামরিক বাহিনীর হাতে রয়েছে আরও দুটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সেগুলো হল, টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স বা থাড। হিট-টু-কিল প্রযুক্তিতে তৈরি এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকানো সম্ভব। বর্তমানে এর কয়েকটি ইউনিট ইসরাইলে মোতায়েন রেখেছে ওয়াশিংটন। গত বছরের ডিসেম্বরে ইয়েমেনের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথিদের ছোড়া ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে শূন্যে ধ্বংস করে খবরের শিরোনামে আসে থাড।
যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট অ্যাডভান্সড কেপেবিলিটি-৩ (পিএসি-৩) নামের এয়ার ডিফেন্সেও রয়েছে হিট-টু-কিল প্রযুক্তি। এতে এর নকশা স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের জন্য করা হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় সংশ্লিষ্ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটিকে মোতায়েন রেখেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। চীনা হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। ওয়াশিংটনের সহযোগিতায় পিএসি-৩ মোতায়েন করেছে জাপানও।
অন্যদিকে, ইসরাইলের হাতে যে আয়রন ডোম রয়েছে, তা কৃত্রিম উপগ্রহ পরিচালিত নয়। স্বল্পপাল্লার রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র, মর্টার ও কামানের গোলা আটকাতে এর নকশা তৈরি করেছেন ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিতের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সঙ্গে চলা যুদ্ধে দখলদার ইসরাইলের এই ‘আয়রন ডোম’ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে। দেশটির দাবি, হামাসের ছোড়া ৯৮ শতাংশ রকেটকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে তাদের ‘আয়রন ডোম’।
আরও কিছু প্রধান পার্থক্য নিচে উল্লেখ করা হলো:
আয়রন ডোম:
উৎস ও ব্যবহার: এটি ইসরাইলের তৈরি একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ২০১১ সাল থেকে ইসরাইল এটি ব্যবহার করে আসছে, মূলত স্বল্প-পাল্লার রকেট এবং কামানের গোলা প্রতিহত করার জন্য।
প্রযুক্তি: এটি রাডার প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট শনাক্ত করে এবং সেগুলোকে আকাশে ধ্বংস করে।
উদ্দেশ্য: এর মূল উদ্দেশ্য হলো একটি নির্দিষ্ট, তুলনামূলকভাবে ছোট এলাকাকে রকেট হামলা থেকে রক্ষা করা। এটি সাধারণত ইসরাইলের শহরাঞ্চল বা সামরিক স্থাপনা রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
কার্যকারিতা: এটি রকেট এবং স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, তবে ব্যাপক সংখ্যক রকেট বা হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো উন্নত হুমকির বিরুদ্ধে এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
অবস্থান: এটি ভূমিভিত্তিক একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
গোল্ডেন ডোম:
উৎস ও ব্যবহার: এটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত একটি উচ্চাভিলাষী মহাকাশভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি এখনো পরিকল্পনা ও নকশার পর্যায়ে আছে, বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রযুক্তি: গোল্ডেন ডোম হবে শত শত স্যাটেলাইটের একটি নেটওয়ার্ক, যা মহাকাশ থেকে শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র (যেমন, ক্রুজ, ব্যালিস্টিক, এমনকি হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র) উৎক্ষেপণ পর্যায় থেকেই শনাক্ত করবে, ট্র্যাকিং করবে এবং লেজার বা অন্যান্য অস্ত্র বহনকারী স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সেগুলোকে ধ্বংস করবে।
উদ্দেশ্য: এর উদ্দেশ্য হলো পুরো যুক্তরাষ্ট্রকে যেকোনো ধরনের আকাশ ও মহাকাশভিত্তিক হামলা থেকে রক্ষা করা। এটি পৃথিবীর অপর প্রান্ত বা মহাকাশ থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রকেও আটকাতে পারবে বলে দাবি করা হয়েছে।
কার্যকারিতা: যেহেতু এটি এখনও একটি পরিকল্পনা, এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। তবে এর ধারণা করা হয়েছে আয়রন ডোমের চেয়ে বহুগুণ উন্নত এবং বিস্তৃত হবে।
অবস্থান: এটি মূলত মহাকাশভিত্তিক একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।