গণঅভ্যুত্থানের পতাকাবাহী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাত্র এক বছরের মধ্যে দখল, দুর্নীতি আর বিভাজনের রাজনীতিতে বিতর্কিত। প্রশ্ন উঠেছে, যারা হাসিনা সরকারের ক্ষমতার পাশা উল্টে দিয়েছিল, তারাই কি আজ ক্ষমতার লেজুড়ে বন্দি?
নাহিদ ইসলাম যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন, উমামা ফাতেমা তখন এর বিরোধিতা করে প্ল্যাটফর্মটিকে জিইয়ে রাখেন। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সাধারণ ছাত্রদের এই প্ল্যাটফর্মকে ‘দলীয় সংগঠনে’ রূপান্তরের এবং ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে’ বাধ্য করার অভিযোগ এনে সংগঠন ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন উমামা।
অভ্যুত্থানের সাফল্য বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন তরুণ মনে জাগিয়েছিল, তা পূরণ করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে জন্ম নেয় আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপি। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন এনসিপির ছায়ায় পরিণত হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
বছর পূর্ণ না হতেই চাঁদাবাজি, মামলা-বাণিজ্য, নিরীহ মানুষকে হয়রানি, দখল-বাণিজ্য, অবৈধভাবে হাটবাজার নিয়ন্ত্রণসহ নানান অভিযোগে জর্জরিত ছাত্রদের এই প্ল্যাটফর্ম।
গত বছর ১ জুলাই যখন চার দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের প্ল্যাটফর্মটি গঠিত হয়, তখন এর সংগঠকরাও হয়ত ভাবতে পারেননি, মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে পরের মাসের ৫ অগাস্ট তারা দেড় দশকের প্রবল প্রতাপশালী শাসক শেখ হাসিনাকে হটিয়ে দিতে পারবেন। হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলবেন। ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই আন্দোলনের সমাপ্তির দিনটিকে আন্দোলনকারীরা ৫ অগাস্ট না বলে ৩৬ জুলাই বলতে পছন্দ করেন।
সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ২০২৪ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন ছিলেন নাহিদ ইসলাম। আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর তিনি মন্ত্রী মর্যাদায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হন। তারপর উপদেষ্টার পদ ছেড়ে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্ববায়কের দায়িত্ব নেন।
নতুন দল গঠনের আগেই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করেছিল। এ বছরের ৭ মার্চ এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর আগের জায়গায় নেই। সেখান থেকে একটি ছাত্র সংগঠন তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয়টা এখন আর এক্সিস্ট করে না।”
ওই দিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এর বিরোধিতা করে লিখেছিলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটি বিলুপ্ত করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশীদার ছাত্রদের সবাই নতুন রাজনৈতিক দল বা নতুন ছাত্র সংগঠনে যুক্ত হয়নি। অংশীদারদের আলোচনা ছাড়া প্ল্যাটফর্ম বিলুপ্ত হবে না। তাই বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ রইল।”
বছর শেষে দেখা যাচ্ছে, শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে ২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কমিটি দিয়ে পরিচালিত হত, তাদের অধিকাংশই নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি অথবা তাদের ছাত্রসংগঠন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদে যুক্ত হয়েছেন।
আন্দোলন চলাকালে চব্বিশের জুলাই-অগাস্টে সারাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ১৫৮ জন সদস্যকে ধাপে ধাপে সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়ক হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের অধিকাংশও এখন এনসিপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন।